শিয়াল রাজা।
উত্তরাধিকার সূত্রে বনের রাজা সিংহ হলেও বাঘ তা মানতে নারাজ। বাঘের একটাই কথা সিংহের চেয়ে তার ক্ষমতা কম কিসের। সুতরাং এখন থেকে বনের রাজা সিংহ নয়, হবে বাঘ।
বাঘের এই ঘোষণা এক কান দুই কান করতে করতে সিংহের কানে গিয়ে পৌঁছায়। সিংহ বাঘের এই দুঃসাহস দেখে নিজেকে সামলিয়ে রাখতে না পেরে বাঘকে শাস্তি দেওয়ার ঘোষণা দেয়।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে সারা জঙ্গলে অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে একটি বাঘ আর একটি সিংহ অবশিষ্ট রয়েছে। যারা দুজন অবশিষ্ট রয়েছে তাদের মধ্যেও সিংহাসন নিয়ে গন্ডগোল। বনের অন্য নিরীহ প্রাণীরা সুখে শান্তিতে বসবাস করার চেয়ে আতঙ্কগ্রস্তই বেশি।
তাদের কেউই বাঘ এবং সিংহকে রাজা হিসেবে চায় না। কারণ তারা জানে, যেই ই রাজা হোক নিরীহ প্রাণীদের রক্ষে নেই। প্রতিদিন কাউকে না কাউকে ধরে ধরে খাবে। এই অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নিরীহ প্রাণীদের কেউ কেউ শিয়াল পন্ডিতের কাছে বুদ্ধি পরামর্শের জন্য আসে।
শিয়াল পন্ডিত তাদের কাছে জানতে চায়, সে যদি বাঘ ও সিংহকে এলাকা ছাড়া করতে পারে তাহলে প্রাণীরা তাকে রাজা হিসেবে মানবে কি না? উপস্থিত প্রাণীরা চিন্তা করে দেখে, বাঘ ও সিংহের চেয়ে শিয়াল রাজা হলে মন্দ কিসের? বরং তারা একজন বুদ্ধিমান রাজা পাবে। তাই সকলেই শিয়ালকে রাজা হিসেবে মানার প্রতিশ্রুতি দেয়।
শিয়াল পন্ডিত ও এই সুযোগ যাতে হাতছাড়া না হয়, তাই ভালোভাবে বুদ্ধি আঁটতে থাকল। একপর্যায়ে তার মাথায় একটা জটিল বুদ্ধি আসলো এবং সেই অনুযায়ী সে প্রথমে বাঘের কাছে গেল।
বাঘকে সিংহের বিরুদ্ধে নানা ধরনের কুটবুদ্ধি দিয়ে ক্ষেপিয়ে তুলল সে। বাঘ যখন সিংহের সঙ্গে লড়াই করতে প্রস্তুত হলো, ঠিক তখনই সে আবার সিংহের কাছে গেল এবং সিংহকে বাঘের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলল। সিংহ তো আগে থেকেই বাঘের বিরুদ্ধে ক্ষ্যাপা ছিল।
শিয়ালের কথাতে সে আরো বেশি রাগান্বিত হলো এবং বাঘের সঙ্গে লড়াই করার জন্য রাজি হলো।
শিয়াল এই মোক্ষম সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য বনের প্রাণীদের মাঝে বাঘ ও সিংহের লড়াইয়ের দিন ঘোষণা করে দিল এবং এটাও বলল যে, এদের মধ্যে যে জিতবে সেই হবে এই বনের রাজা। বাঘ ও সিংহকেও আলাদা আলাদা ভাবে জানিয়ে আসলো সে।
শিয়ালের কুটবুদ্ধির কথা বাঘ-সিংহ কেউ বুঝতে না পেরে নির্ধারিত দিনে হাজির হলো লড়াই করার জন্য। অবশেষে তাদের মধ্যে প্রচন্ড লড়াই শুরু হয়ে গেল। দিন যায় রাত যায় কেউ কাউকে পরাজিত করতে পারে না। এভাবে সপ্তাহখানেক অতিবাহিত হওয়ার পর দু’জনই ক্লান্ত হয়ে পড়ল এবং এক পর্যায়ে সিংহের হাতে বাঘটা মারা পড়ে গেল।
সিংহ বেঁচে থাকলেও তার আর ওঠার কোনো ক্ষমতা ছিল না। তাই এই সুযোগে শিয়াল পন্ডিত তার পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অন্যান্য প্রাণীদের নিয়ে সিংহের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং সিংহকেও প্রাণে মেরে ফেলল।
পূর্বের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অন্য প্রাণীরা শিয়াল পন্ডিতকে বনের রাজা হিসেবে ঘোষণা করল এবং তাকে বসালো রাজ সিংহাসনে। এভাবে কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর বাঘ আর সিংহের মৃত্যুর সংবাদ আস্তে আস্তে লোকালয়ে এসে পৌঁছাল।
লোকালয়ের মানুষ জন এর আগে বাঘ আর সিংহের ভয়ে বনের ভেতরে প্রবেশ করার সাহস পেত না। তারা এই খবরে হরিণ শিকার করার জন্য বনের মধ্যে অনায়াসে প্রবেশ করতে থাকল। লোকালয়ের মানুষজনের অত্যাচার এতটাই বেড়ে গেল যে, হরিণসহ অন্যান্য প্রাণীদের বনের মধ্যে বেঁচে থাকা দুষ্কর হয়ে গেল। তারা এ থেকে উত্তরণের জন্য শিয়াল রাজার সাথে দেখা করতে গেল।
কিন্তু একি! তারা দেখতে পেল শিয়াল রাজাকে একজন মানুষ বড় লাঠি নিয়ে তাড়াচ্ছে। এই অবস্থা দেখে সবাই যার যার মতো পালিয়ে গেল প্রাণ বাঁচানোর জন্য। তারা অবশেষে তাদের ভুল বুঝতে পেরে বাঘ ও সিংহের মৃত্যুর জন্য আফসোস করতে থাকল।
তারা যখন বুঝলো, ‘যে যার জন্য যোগ্য তাকে সেখানেই বসানো উচিত’ ততক্ষণে মানুষের হাতে তাদের নিশ্চিহ্ন হওয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকল না।