কফি পানে মানসিক চাপ কমে, দিনভর সতেজ রাখে।
সকালবেলা গরম গরম এককাপ কফি শুধু সকালটাকে চাঙ্গা করবে না, এটি আপনার জীবনকে চাঙ্গা করতে পারে। কফির অনেক উপকারীতা রয়েছে। কফি আমেরিকা ও ইউরোপে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় একটি পানীয়।
কফি পানের সূত্রপাত:
১৫০০ শতাব্দীতে ইয়েমেনে কফি পান করার সূত্রপাত হয়েছিল। প্যারিসের ক্যাফে বা রোমান এস্প্রেসো বারের চিত্রটি প্রায়শই প্রথম কফি পানকারীদের কোথাও বসে কফি খাওয়ার প্রমান হিসাবে দেখা হয়।
বিশ্বের শীর্ষ তিনটি কফি-পানকারী দেশ হচ্ছে ফিনল্যান্ড, নরওয়ে এবং আইসল্যান্ড। এছাড়া ডেনমার্ক, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রথম সারির কফি পানকারী দেশ।
কফির জনপ্রিয়তা:
কফি বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় পানীয়গুলির মধ্যে একটি, যেটি প্রতিদিন কয়েক বিলিয়ন কাপ পান করা হয়। কফি বীজ থেকে তৈরি, এটি এমন একটি পানীয় যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় অর্ধেক প্রাপ্তবয়স্করা উপভোগ করে।
আমেরিকা প্রতি বছর কফিতে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। তবে সবথেকে বেশি কফি পান করেন ফিনল্যাণ্ড ও নরওয়ের অধিবাসীরা।
আগামী দশকে বিশ্বব্যাপী চাহিদা আরও ৪০-৫০ মিলিয়ন ব্যাগ কফি বৃদ্ধি পাবে যা ব্রাজিলের পুরো বার্ষিক উত্পাদনের চেয়ে বেশি।
জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে কফি ফসলের বর্তমান হুমকির কারণে, বিশ্ব সম্ভবত তীব্র কফি ঘাটতির মুখোমুখি হতে পারে।
কফির উপকারীতা
সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, কফি-টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হ্রাস, ত্বকের ক্যান্সার, লিভার ক্যান্সার, প্রোস্টেট ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, কফি বীজ আসলে বেশ কয়েকটি ইতিবাচক স্বাস্থ্য বেনিফিট সরবরাহ করতে পারে। কফির উপকারীতা নিচে আলোচনা করা হল:
এটি দরকারী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুলির উৎস :
কফির অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট যৌগগুলির মধ্যে রয়েছে ক্যাফিক অ্যাসিড, ক্যাফিন, ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড, ইউজেনল, গামা-টোকোফেরল, আইসোইজেনল, পি-কুমারিক অ্যাসিড, স্কোপলেটেন এবং ট্যানিক এসিড।
আসলে, কফি আমেরিকান ডায়েটে উপকারী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুলির প্রাথমিক উৎস।
কফি ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হ্রাস করে:
কফি গ্রহণ এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হ্রাসের মধ্যে একটি সম্পর্ক রয়েছে বলে বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন।
সম্প্রতি প্রমাণিত হয়েছে যে প্রতি কাপ কফি পানে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ৭% হ্রাস পায়।
এছাড়াও, বিজ্ঞানের গবেষণায় ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে কফি ব্যবহারকারীরা হালকা পানীয় বা নন-পানীয় পানকারীদের তুলনায় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ৫০% কমিয়েছেন।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা ২০ বছর ধরে ১ লক্ষ মানুষের উপর একটি গবেষণা চালান যেখানে তারা কফি পান ও টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকির উপর যোগসূত্র খুঁজতে চেষ্টা করেন।
তাঁরা দেখতে পান যে যারা তাঁদের কফি পানের পরিমাণ ১ কাপ বৃদ্ধি করেছেন তাঁদের টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি ছিল ১১% কম।
হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস :
কফির আরও আশ্চর্যজনক একটি উপকার হল আমাদের হৃদরোগের সাথে। যদিও সাময়িকভাবে কফি কারও রক্তচাপকে বাড়িয়ে তোলে তবে প্রতিদিন দু’কাপ পান করলে হৃদরোগের মতো কিছু নির্দিষ্ট কার্ডিওভাসকুলার সমস্যা হ্রাস করে এবং স্ট্রোকের ঝুঁকিও হ্রাস করে।
সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, নিয়মিত কফি পানকারীরা (প্রতিদিন ২-৪ কাপ) হৃদরোগের ঝুঁকিতে ২০% কম ছিলেন যারা মোটেই কফি পান করেন না বা সামান্য পান করেন তাদের তুলনায়।
নির্দিষ্ট ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে :
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে এটি কেবল ত্বকের ক্যান্সার নয়, বিভিন্ন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করতে পারে।
লিভার এবং প্রোস্টেট ক্যান্সার উভয়ের ঝুঁকি হ্রাস হতে পারে। যে পুরুষরা কফি পান করেন তাদের আক্রমণাত্মক প্রস্টেট ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি কম হতে পারে।
এছাড়াও, নতুন একটি গবেষণা থেকে জানা গেছে যে প্রতিদিন এক কাপের চেয়ে কম পান করে মহিলাদের তুলনায় প্রতিদিন চার বা ততোধিক কাপ কফি পান করা মহিলাদের মধ্যে এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সারের ঝুঁকি ২৫% হ্রাস করে।
গবেষকরা নিয়মিত কফি পান এবং লিভার, কোলন, স্তন এবং মলদ্বার ক্যান্সারের কম হারের মধ্যেও সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন।
ল্যান্সেট অনকলজি জার্নালে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয় যে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশান (WHO) -এর “ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার” ২৩ জন আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীর সমন্বয়ে একটি দল গঠন করে।
তাঁরা ১,০০০ এরও বেশী গবেষণা চালায় এবং প্রমাণ পায় যে কফি পান করলে ক্যান্সার হয় না বরং এটা লিভার ক্যান্সার ও জরায়ু ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি কমায়।
আয়ু বৃদ্ধি এবং স্মৃতিশক্তি ঠিক রাখে :
ক্যাফিনেটেড কফি পান আমাদের আয়ু বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এএআরপি এবং জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট উভয়ের দ্বারা পরিচালিত গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে কফি পান করে নারী এবং পুরুষরা তাদের অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে।
বয়স্ক মানুষ যারা নিয়মিত কফি পানে অভ্যস্ত, তাদের আলযহাইমার্স রোগ হওয়ার সম্ভাবণা কম।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে মধ্য বয়সে দিনে ৩ থেকে ৫ কাপ কফি পান করলে বার্ধক্যে আলযহাইমার্স রোগ হওয়ার ঝুঁকি ৬৫% কমে।
কফি পানের ঝুঁকি সমূহ:
কফির উপকারীতার পাশাপাশি কিছু স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে। নিচে কফির কিছু স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে আলোচনা করা হল:
বাচ্চাদের জন্য কফি ও ঘুমের সমস্যা :
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ৫-৭ বছর বয়সী বাচ্চারা ক্যাফিন গ্রহণের ফলে দেরি করে ঘুমাতে যায়।
ক্যাফিন একটি উদ্দীপক উপাদান এটা সবারই জানা তাই ক্লান্তি দূর করতে আমরা কফি পান করে থাকি। কিন্তু, দিনের শেষে কফি পান করলে তা আপনাকে সারা রাত জেগে থাকতে বাধ্য করতে পারে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ঘুমাতে যাওয়ার ৬ ঘন্টা আগে কফি পান করলে তা সেই রাতের ঘুম এক ঘন্টা কমায়।
কফি অনিদ্রা ও অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে :
আপনার প্রাত্যহিক এক কাপ কফি আপনার পক্ষে পিক-মি-আপ অর্থাৎ ভোরবেলা আপনাকে জাগিয়ে তোলা ছাড়াও আরও বেশি কিছু করছে। কফিতে আছে প্রচুর পরিমাণে ক্যাফিন।
শুধু এক কাপ কফিতেই আছে ৯৫ মিলিগ্রাম ক্যাফিন যা সকালে আপনাকে উদ্দীপ্ত রাখারা জন্য পর্যাপ্ত। কফি আসক্ত ব্যক্তির মধ্যে ড্রাগ আসক্ত মানুষের মত মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
কফি হাড়ের ক্ষতি করতে পারে:
বিভিন্ন সময়ে কিছু রিপোর্টে বলা হয় যে যারা অতি মাত্রায় কফি পান করেন তাদের হাড় দুর্বল হয়ে পড়ে।
তাই অনেক ডাক্তার ও বিজ্ঞানীরা মনে করেন শরীরের ক্যালসিয়াম গ্রহণ করার ক্ষমতার উপর ক্যাফিন নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তবে এই বিষয়ের পক্ষে কোনো কার্যকরী প্রমান নেই।
তাই বিজ্ঞানীরা মনে করেন এটা হতে পারে কারণ কফি পানকারীরা হয়তো পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম খান না। অতি মাত্রায় কফি পান করলে দুধ, আলমন্ড, আমড়া, ব্রকলির মত ক্যালসিয়ামপূর্ণ খাদ্য গ্রহণ করা উচিৎ।
খারাপ কফি বিষাক্ত হতে পারে :
খারাপ মানের কফি বা মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া কফি খাবেন না।
গর্ভবতী হলে দিনে এক কাপের বেশি পান করবেন না :
কোনও ভ্রূণের উপর কফির প্রভাব নিয়ে গবেষণাগুলি বিতর্কিত হয়েছে, তবে একটি বিষয় নিশ্চিত: আপনি যদি গর্ভবতী হয়ে কফি পান করেন তবে ক্যাফিনও ভ্রূণে পৌঁছে যাবে এবং আপনার শিশু ক্যাফিনের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল হবে।
এখন শুধু আমেরিকা নয় সারা বিশ্বের প্রায় প্রতিটি কোণায় স্টারবাক্স সহ বিভিন্ন কফি স্টোর মানুষের জীবনযাত্রার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।