মেথি চুল পড়া কমাতে, রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে ও হরমোন বৃদ্ধিতে কার্যকরী।

আমরা অনেকেই নারকেলের তেলে মেথি ভিজিয়ে সেই তেল মাথায় দিয়ে থাকি। এতে মাথা ঠান্ডা থাকে সাথে সাথে চুলের সমস্যাও দূর হয়। এক কথায় চুলের অনেক সমস্যার সমাধান হলো মেথি।

মেথি চুলের সমস্যা দূর করতে যেমন ওস্তাদ ঠিক তেমনি স্বাস্থ্যগত দিক থেকেও উপকারী। মেথি গাছ ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীন ঔষধি গাছ হিসাবে পরিচিত।

মেথির পাতা শাক হিসাবে খাওয়া হয়। মেথি শাক গ্রাম বাংলার মানুষের প্রিয় একটি শাক। মশলা হিসাবেও মেথি প্রচুর ব্যবহার হয়।। এটি পাঁচ ফোড়নের একটি উপাদান। মেথির বৈজ্ঞানিক নাম Trigonella foenum-graecum ইংরেজীতে fenugreek.

স্বাদে একটু তিতা, তাই হয়তো স্বাস্থ্য উপকারীতাও একটু বেশি। রাতে এক চামচ মেথি পানিতে ভিজিয়ে রেখে সেই পানি এবং ঐ ভিজানো মেথি প্রতিদিন সকালে খালি পেটে চিবিয়ে খেলে শরীরের বিভিন্ন ধরণের রোগ-জীবাণু মরে যায়। এছাড়া রক্তের চিনির মাত্রা, ক্ষতিকর কোলেস্টেরল বা চর্বির মাত্রা কমে যায়।

অনেক ডাক্তার ডায়াবেটিসের রোগী থেকে শুরু করে হার্টের রোগের রোগীকেও মেথি খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

মেথির পুষ্টি উপাদান

নিচে মেথির কিছু পুষ্টি উপাদান দেওয়া হলো –

  • ফাইবার: ৩ গ্রাম
  • প্রোটিন: ৩ গ্রাম
  • কার্বহাইড্রেট: ৬ গ্রাম
  • ফ্যাট: ১ গ্রাম
  • আয়রন: ২০% (DV)
  • ম্যাঙ্গানিজ: ৭% (DV)
  • ম্যাগনেসিয়াম: ৫% (DV)

মেথির উপকারিতা

মেথির ব্যবহার শুধুমাত্র রান্নাঘরেই সীমাবদ্ধ নয়- আয়ুর্বেদিক ঔষুধ প্রস্তুতিতে, রূপচর্চায় আর চুলের যত্নে মেথি ব্যবহার হয়ে থাকে। নিচে মেথির উপকারিতা দেওয়া হলো –

ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ:

প্রচুর ফাইবার রয়েছে মেথি বীজে যা ওজন কমায় এবং পেট ভরিয়ে রাখে ফলে খিদের অনভূতি কমিয়ে ওজন হ্রাস করতে সাহায্য করে।

২০১৫ সালের এক গবেষণায়, ৯ ওভারওয়েট কোরিয়ান মহিলার দুপুরে খাওয়ার আগে মেথি চা খেতে দেওয়া হয়। রিপোর্ট অনুযায়ী মেথি চা যারা পান করেছিলেন তারা কম ক্ষুধার্ত এবং পূর্ণতা অনুভব করেছিলেন।

রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে:

রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে মেথি।

একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, টাইপ-1 ডায়াবেটিসযুক্ত ব্যক্তিরা দুপুরের এবং রাতের খাবারে ৫০ গ্রাম মেথি বীজ গুঁড়ো করে খাওয়ার ১০ দিন পরে তাদের রক্তে শর্করার মাত্রা এবং খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) এর মাত্রা হ্রাস পেয়েছিল।

অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়াবেটিসবিহীন লোকেরা মেথি খাওয়ার খাওয়ার ৪ ঘন্টা পরে তাদের রক্তে শর্করার মাত্রা ১৩.৪% হ্রাস অনুভব করেছিল।

গবেষণা করে দেখা গেছে যে, ডায়াবেটিক রোগীরা নিয়মিত মেথি খেলে, তাদের ডায়াবেটিসজনিত অসুখগুলো কম হয় এবং স্ট্রোক হওয়ার প্রবণতা তুলনামূলকভাবে কম। ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য মেথি শ্রেষ্ঠ পথ্য।

বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েদের জন্য:

শিশুর বিকাশের জন্য মায়ের বুকের দুধের কোনও বিকল্প নেয়। তাই মায়ের বুকে পর্যাপ্ত দুধ থাকাও গুরুত্বপূর্ণ।

গবেষণায় দেখা যায় যে, বুকের দুধ বৃদ্ধিতে মেথি একটি নিরাপদ প্রাকৃতিক বিকল্প।

নতুন ৭৭ জন মায়েদের উপর ১৪ দিনের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, মেথি বীজের চা পান করায় বুকের দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, যা বাচ্চাদের ওজন বাড়াতে সহায়তা করে।

পুরুষের হরমোন বৃদ্ধি:

টেস্টোস্টেরন হলো পুরুষের হরমোন। মেথি পুরুষের হরমোন টেস্টোস্টেরন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। এটি পুরুষের শক্তি বৃদ্ধি করে।

একটি ৬-সপ্তাহের গবেষণায় ৩০ জন পুরুষকে ৬০০ মিলিগ্রাম মেথি সাপ্লিমেন্ট দিয়ে তাদের ক্রিয়াকলাপ এবং লিবিডোর পরিবর্তনগুলি মূল্যায়ন করা হয়। বেশিরভাগ অংশগ্রহণকারীরা বর্ধিত শক্তি এবং উন্নত ক্রিয়াকলাপ রিপোর্ট করেন।

চুল পড়া কমাতে ও খুশকি দূর করতে:

চুল পড়ে যাওয়ার সমস্যায় কম-বেশি সকলেই ভোগে। এই সমস্যা থেকে চুলকে রক্ষা করতে মেথির ভূমিকা অপরিসীম। মেথি পেস্ট করে নিয়ে তার সাথে লেবুর রস মিশিয়ে একটি পেস্ট তৈরি করুন।

এই পেস্টি হেয়ারমাস্ক হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। এটি নিয়মিত ব্যবহার করলে চুলপড়া ও খুশকি কমে যাবে। এছাড়া নারিকেল তেলের সাথে মেথি ব্যবহার করতে পারেন।

মাসিকের ব্যথা কমায়:

মাসিকের ব্যথা, এটা মেয়েদের একটি কমন সমস্যা। ঋতুস্রাবের ব্যথা কমাতে সহায়তা করে মেথি। ঋতুস্রাবের বা মাসিকের সময় ভেজানো মেথি চিবিয়ে খেলে মাসিকের ব্যথা কমে যায়।

বাতের ব্যথা কমে:

বাতের ব্যথা প্রায় সকল চল্লিশোর্ধ্ব মানুষেরই সমস্যা। ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ-এর প্রতিবেদন অনুসারে মেথির ইস্ট্রোজেনের ওপরে প্রভাব এতটাই বেশি যে বর্তমানে ডাক্তারেরা মেথির ব্যবহারকে ইস্ট্রোজেন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপির সাথে তুলনা করছেন। মেথি বাতের তীব্র ব্যথা কমাতে ভীষণভাবে কার্যকর।

ত্বকের সমস্যায় ও ব্রণ নির্মূলে:

ত্বকে ঘা, ফোঁড়া, ইরিটেশন দূরীকরণ, বয়সের ছাপ পড়া থেকে রক্ষা ইত্যাদিতে মেথির জুড়ি নেই। প্রতিদিনের ফেসপ্যাকে মেথি ব্যবহার করলে মুখের ব্রণ, কালো দাগ ও ফুসকুড়ি নিরাময় হয়। মেথির ভিতর থাকা এন্টি-ব্যাকটেরিয়াল পদার্থ ত্বকের গভীরে যায় ও ব্রণ নির্মূল করতে সাহায্য করে। এক্ষত্রে মেথি বীজ পেস্ট করে তার সাথে মধু যোগ করে ব্রণের উপর লাগিয়ে সারারাত রাখুন। তারপর সকালে কুসুম গরম পানি দেয়ে ধুয়ে ফেলুন। এতে ত্বকের শুষ্কতাও দূর হবে।

কৃমি কমে:

প্রতিদিন সকালে খালি পেটে মেথি চিবিয়ে খেলে বা এক গ্লাস পানিতে মেথি ভিজিয়ে রেখে সেই পানি সকাল বেলা পান করলে শরীরের রোগ-জীবাণু মরে। রোগ জীবাণুর মধ্যে বিশেষত উল্লেখযোগ্য হল কৃমি।

বার্ধক্য প্রতিরোধ:

মেথির বীজ ব্যবহারে ত্বক হয়ে উঠবে সজীব ও প্রাণবন্ত। মেথির বীজে ত্বকের মৃত কোষ তুলে ত্বক তরুণ ও উজ্জ্বল করে তুলতে পারে। এক্ষত্রে মেথির গুঁড়ো করে নিয়ে তাতে সামান্য পানি আর দই মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে নিন। তারপর সারা মুখে ভালো করে এই প্যাক লাগিয়ে রেখে ২০ মিনিট পর ভালো করে ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে ২ বার করে এই প্যাক ব্যবহার করুন।

সতর্কতা:

মেথির কিছু ক্ষতিকর দিক রয়েছে। এবার জেনে নেওয়া যাক মেথির অপকারী দিক সমূহ:

  • এটি তেঁতো ফলে অনেকের বমি বমি ভাব লাগতে পারে।
  • মেথি খেলে ব্লাড সুগারের পরিমাণ হঠাৎ কমে যেতে পারে। তাই পরিমাণ মতো খেতে হবে।
  • গর্ভবতী মহিলাদের জন্য মেথি নিরাপদ না।

আপনি যদি জটিল কোনো রোগে আক্রান্ত হন বা অন্য কোনো কারণে রেগুলার কোনো মেডিকেল কোর্স-এর মধ্য দিয়ে যান তাহলে অবশ্যই খাওয়ার আগে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন।