থাকলে পিতামাতা করিও যতন। হারালে বুঝবে সেদিন হারিয়েছো সবথেকে মূল্যবান রতন।

                                পিতামাতার প্রতি কর্তব্য

 

সূচনা বা ভূমিকা:

এই পৃথিবী অল্প কয়েক দিনের জন্য মাত্র। এর মধ্যে আমরা মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে হাজারও সম্পর্কের মাঝে জড়িয়ে পড়ি। এতো সব সম্পর্কের মধ্যে থেকে  তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্কের বন্ধন গড়ে ওঠে সন্তান এবং মাতাপিতার মধ্যে।

যারা আমাদেরকে এই পৃথিবীতে এনে এর অফুরন্ত সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ করে দিল তারা আমাদের শ্রদ্ধেয় বাবা-মা। খুব অসহায় অবস্থায় একটি শিশু জন্মগ্রহণ করে।

পৃথিবীতে এসে পিতা-মাতার যথাযথ লালন-পালন, আদর, স্নেহ, মমতা ও শিক্ষা-দীক্ষার মাঝে বেড়ে ওঠে সন্তান। সুতরাং সন্তানের জীবনে পিতামাতার অবদান অনস্বীকার্য। পিতা-মাতার এই অবদান পরিমাপ করা বা এর মূল্য নির্ণয় করা কোনো সন্তানের পক্ষেই পুরোপুরিভাবে সম্ভব নয়।

সন্তানের জন্য পিতামাতা একমাত্র নিরাপদ স্থান। সুতরাং প্রত্যেক সন্তানের উচিত মাতা-পিতার প্রতি তাদের যে কর্তব্য তা সঠিকভাবে পালন করা এবং সব সময় তাদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখা।

Parents the shadow of divine. পিতামাতা ঐশ্বরিক বা ঈশ্বরের ছায়া। কিন্তু পিতামাতা থাকতে এটা অনেক সন্তান বুঝতে পারে না বা গুরুত্ব দেয় না। পিতামাতা মরে গেলে বা এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলে তখন কেঁদে বুক ভাসায়।

পৃথিবীতে সবচেয়ে মধুর শব্দটি হচ্ছে মা। জগৎ সংসারের শত দুঃখ-কষ্টের মাঝে যে মানুষটির একটু সান্ত্বনা আর স্নেহ-ভালোবাসা আমাদের সমস্ত বেদনা দূর করে দেয় তিনিই হলেন মা। মায়ের চেয়ে আপনজন পৃথিবীতে আর কেউ নেই।

দুঃখে-কষ্টে, সংকটে-উত্থানে যে মানুষটি স্নেহের পরশ বিছিয়ে দেয় তিনি হচ্ছেন আমাদের সবচেয়ে আপনজন মা। প্রত্যেকটি মানুষ পৃথিবীতে আসা এবং বেড়ে ওঠার পেছনে প্রধান ভূমিকা মায়ের। মায়ের তুলনা অন্য কারো সঙ্গে চলে না। মা হচ্ছেন জগতের শ্রেষ্ঠ সম্পদ।

মা-বাবার সাথে কেমন আচরণ করবেন?

মাথা নত করে এবং তাদের পা স্পর্শ করে আপনার পিতামাতাকে শুভেচ্ছা জানান। আমাদের মহান হিন্দু সংস্কৃতি আমাদের শিখায় যে ‘’मातृदेवो भव । पितृदेवो भव-অর্থ,‘ মা ও বাবা God বা ঈশ্বরের মতো ’।

প্রত্যেক সন্তানের উচিত সব সময় পিতা-মাতার বাধ্য থাকা এবং তাদের আদেশ নিষেধ মেনে চলা। বাবা-মায়ের যখন বার্ধক্য চলে আসে তখন তারা নবজাতক শিশুর মতোই অসহায় হয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে পিতা-মাতাকে বোঝা না ভেবে তাদের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করা সন্তানের দায়িত্ব।

পাশ্চাত্য মনীষী রাস্কিন মনে করেন পৃথিবীতে মানুষের তিনটি কর্তব্য আছে-‘‘Duty towards God, duty towards parents and duty towards mankind’’. ফলে পেশাগত সফলতা টিকিয়ে রাখতে এবং তথাকথিত অভিজাত সমাজে নিজের মূল্যবোধ বজায় রাখতে গিয়ে সন্তানের কাছে তার নিজের বৃদ্ধ বাবা-মার স্থান হয় বৃদ্ধাশ্রম। এই অপসংস্কৃতির হাওয়া আমাদের দেশেও বইছে। আমাদের শিক্ষিত সচেতন সমাজের উচিত এটা রোধ করা। তাই পিতা-মাতা মনে কষ্ট পায় এমন কোনো কাজ করা উচিত নয়।

হিন্দু ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ আছে ‘জননী স্বর্গ অপেক্ষা গরীয়সী। পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাই পরম তপস্যার ব্যক্তি।’ খ্রিস্টান ধর্মেও একই রকমের কথা উল্লেখ আছে। বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটকে বলা হয়েছে ‘মাতাপিতার সেবা করাই সবচেয়ে উত্তম’। ইসলাম ধর্মে- মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।

মাতাপিতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল মহান ব্যক্তিদের দৃষ্টান্ত:

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় পৃথিবীতে মরেও যারা অমর এবং চিরস্মরণীয় হয়ে মানুষের হৃদয়ে আজও বেঁচে আছেন। তাঁরা সকলেই মাতৃ ও পিতৃভক্তির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

কিছু মহান পুরুষ যারা তাদের পিতামাতার সেবা করেছেন

শ্রাবণকুমার:

শ্রাবনকুমার তার অন্ধ পিতামাতার সেবা করেছিলেন অবিরাম এবং নিরলসভাবে। তাঁর বাবা-মা যখন কাশী তীর্থযাত্রায় যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, তখনই তিনি যাত্রা শুরু করার জন্য প্রস্তুতি শুরু করেন। তিনি বাঁশের লাঠির দুই প্রান্তে ঝুঁড়ির ব্যবস্থা করলেন। তিনি তার পিতামাতাকে কাশীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য এটি ব্যবহার করেছিলেন। কোন বাহন নয়; পায়ে হেঁটে অর্থাৎ পায়ে যাত্রা করে।

ভগবান শ্রীরাম:

শ্রীরাম আন্তরিকভাবে তাঁর সৎ মা কৈকেয়ীর আদেশ মানলেন এবং অযোধ্যা রাজ্যের দায়িত্ব তার ছোট ভাই ভরতকে হস্তান্তর করে ১৪ বছরের জন্য বনে নির্বাসনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। তিনি তাঁর বাবার প্রতিশ্রুতিও পালন করেছিলেন।

আমাদের প্রিয় নবী রাসূল (স.) শৈশবেই তাঁর মাকে হারিয়ে দুধমাতা হালিমার স্নেহ-মমতায় বেড়ে ওঠেন। দুধমাতা হলেও তিনি তাঁকে নিজের মায়ের মতোই ভালোবাসতেন।

হযরত বায়েজীদ বোস্তামি ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাম ইতিহাসে মাতৃভক্তদের তালিকায় চিরকালই স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।  ভক্ত পুণ্ডালিক, ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ, হাজী মুহম্মদ মহসীন, জর্জ ওয়াশিংটন ও আলেকজান্ডার প্রমুখ মহান ব্যক্তিগণ মাতা-পিতার প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি প্রদর্শনের ক্ষেত্রে ইতিহাসে যুগ-যুগান্তর ধরে চির স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন এবং থাকবেন।

পিতা-মাতার প্রত্যাশা পূরণ:

সন্তানের বেড়ে ওঠা, তার যথাযথ লালন-পালন, তাকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলা এসব ঘিরেই পিতা-মাতার জগৎ। পিতামাতা সন্তানের জন্য সীমাহীন কষ্ট স্বীকার করেন। সব বাবা-মার একটাই প্রত্যাশা-‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’। সন্তানের সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠার পেছনে বাবা-মার নিরলস সাধনা বিরাট ভূমিকা পালন করে। প্রত্যেক মাতা-পিতাই চান তাদের ছেলেমেয়েরা সুসন্তান হিসেবে সমাজে মাথা তুলে দাঁড়াক, সকল প্রকার অন্যায় ও মিথ্যাকে প্রতিহত করার ক্ষমতা অর্জন করুক। এসব প্রত্যাশা পূরণ করার মাধ্যমেও তাদের প্রতি কর্তব্য পালন করা যায়।

অনুগত ও সন্তুষ্ট থাকা:

সব রকম পরিস্থিতিতে পিতামাতার প্রতি অনুগত থাকতে হবে এবং বিরক্ত হওয়া যাবে না। সন্তান যতো বড় মাপের মানুষই হোক না কেনো বাবা-মার কাছে সে শুধুমাত্র তাদের সন্তান। বাবা-মা তাদের সাধ্যমতো আমাদেরকে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু কখনও কিছু দিতে ব্যর্থ হলে তাদের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা যাবে না। সন্তানের কাছ থেকে তারা সন্তানস্বরূপ বিনয়ী আচরণই আশা করেন। পিতামাতা সন্তানের সর্বোত্তম বন্ধু তাদেরকে শান্তিতে এবং চিন্তামুক্ত অবস্থায় রাখা সন্তানের কর্তব্য।

পিতামাতার আদর্শ ও সম্মান বজায় রাখা: প্রত্যেক সন্তানেরই উচিত তাদের পিতামাতার আদর্শ ও ন্যায়নীতি অনুসরণ করে চলা। সমাজে তাদের মান সম্মান ক্ষুন্ন হয় এমন কোনো কাজ করা উচিত নয়। পিতামাতার ভালোবাসা এতটাই গভীর যে সন্তান বিপথগামী হলেও তাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে না। তাই সব সময় তাদের আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে হবে। তবে পিতামাতা যদি ধর্মবিরোধী কোনো কাজ যেমন-শিরক ও কুফরে লিপ্ত হতে বলে তবে সে ক্ষেত্রে তাদের নির্দেশ মানা যাবে না। সমাজে যারা পিতা-মাতার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও সহকর্মী তাদের সাথে সুসম্পর্ক রেখে পিতামাতার সম্মান বৃদ্ধি করা যায়।

সন্তান ও পিতামাতার মধ্যকার সম্পর্ক:

সন্তান তার পিতামাতার সাথে সব সময় সদাচরণ করবে এবং কোমল কণ্ঠে ও মার্জিত ভাষায় কথা বলবে। কোনো অবস্থাতেই পিতামাতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা যাবে না। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে পিতা তার ভরণ-পোষণ ও লালন পালনের ব্যবস্থা করে। মাতৃদুগ্ধ সন্তানের আহারের সংস্থান করেন। সুতরাং সন্তানের সাথে পিতামাতার রক্তের এবং নাড়ীর বন্ধন। বিপথগামীতা এবং অবাধ্যতার দ্বারা এই বন্ধনকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা উচিত নয়।

সন্তানেরা শিখবে আমাদের দেখে
আজ যাঁরা সন্তান, আগামী দিনে তাঁরাই হবেন পিতা-মাতা। আজ যাঁরা বধূ বা জামাতা, আগামীকাল তাঁরাই হবেন শ্বশুর বা শাশুড়ি।সুতরাং, আজকের সন্তানেরা যদি তাঁদের পিতা-মাতার খেদমত করেন, তবে তাঁদের সন্তানেরা তাঁদের থেকে দেখে শিখবে কীভাবে পিতা-মাতার খেদমত করতে হয় এবং তাঁদের বার্ধক্যেও তাঁরা তাঁদের সন্তানের কাছ থেকে অনুরূপ খেদমত পাবেন। আজকের বধূ ও জামাতারা যদি শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতি দায়িত্ব পালনে যত্নশীল হন, তবে পরবর্তী প্রজন্ম তা দেখে শিখবে এবং তাঁরা যখন শ্বশুর-শাশুড়ি হবেন, তখন সেইরূপ সেবা ও সম্মান পাবেন।

এভাবেই গড়ে উঠবে সুখী, সুন্দর ও আনন্দময় পারিবারিক পরিবেশ।

উপসংহার:

সকল ধর্মে পিতামাতার স্থান সবার উপরে। ইহকালীন এবং পরকালীন মুক্তির পথ সুগম করতে হলে পিতামাতার প্রতি কর্তব্যগুলো ঠিকভাবে পালন করতে হবে। সব সময় মনে রাখতে হবে প্রত্যেক বাবা-মা তার সন্তানের ভালো চান। সুতরাং তাদেরকে মেনে চলতে হবে।

সর্বোপরি বলতে পারি, সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে পূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হওয়া পর্যন্ত মা-বাবা সন্তানের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে থাকেন। সন্তানের জন্য এত ভালোবাসার আর কেউ নেই।

কিন্তু অতি দুঃখের সঙ্গে আজকাল দেখা যায়, পিতা-মাতা বার্ধক্যে উপনীত হলে অনেকে তাদের বৃদ্ধাশ্রম নামক কারাগারে পাঠিয়ে দেন। যা একজন সন্তানের কাছ থেকে কোনোভাবেই কাম্য নয়। এতে সৃষ্টিকর্তার আরশ কেঁপে ওঠে। জমিন অভিশাপ করে। তাই আসুন! মা-বাবা দু’জন বা কোনো একজন বেঁচে থাকলেও তাদের সেবা-যত্ন করে ঈশ্বরের  সন্তুষ্টি ও স্বর্গ লাভ করি।

সূত্রঃ

https://www.hindujagruti.org/hinduism-for-kids/441.html

https://www.thehindu.com/news/cities/Madurai/maintaining-parents-is-dharma-not-just-duty/article7910980.ece