তিন গরুর গল্প।

এক জঙ্গলে বাস করত তিনটি গরু। একটি লাল, একটি সাদা ও একটি কালো রঙের। তাদের মধ্যে ভীষণ মিল। প্রতিদিন তারা জঙ্গলের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় ঘুড়ে ঘুড়ে ঘাস খায় আর নিজেদের মধ্যে সুখ-দুঃখের গল্প করে। কখনো একজন অসুস্থ থাকার জন্য বাইরে যেতে না পারলে অন্য দুইজন তার জন্য খাবার সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। এভাবে তাদের বেশ সুখেই দিন কাটছিল।

ঐ জঙ্গলে ছিল একটি হিংস্র বাঘ। সে বেশ কিছুদিন যাবত ঐ গরুগুলির পিছু নিয়ে আছে। তার লক্ষ্য একটাই। যেভাবেই হোক এসব নাদুস নুদুস গরুগুলোকে খেতে হবে। কিন্তু চাইলেই কি আর তা সম্ভব? বাপরে বাপ, ওদের মধ্যে যা মিল। তাছাড়া প্রত্যেকটার শিংগুলোও দেখতে ভয়ংকর। যদি কোনো কারণে কারো ওপর হামলা করে তাহলে নিশ্চিত ঐ শিংয়ের এক গুঁতোতেই দফা রফা হয়ে যাবে।

কোনো ভাবেই উপায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না আবার লোভকেও সংবরণ করা যাচ্ছে না। অবশেষে সে একটা উপায় খুঁজে বের করল। সে পরদিন জঙ্গলের মধ্যে এক পাশে গাছের নিচে চুপ করে ঘাপটি মেরে বসে থাকল। একটু পরেই গরুগুলি সেখানে খাবার জন্য এলো। গরুগুলি খেতে খেতে যেই মাত্র কালো গরুটি একটু বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো, সঙ্গে সঙ্গে বাঘ সাদা ও লাল গরুকে উদ্দেশ্য করে বলল, বাহ্ তোমরা দেখতে কত সুন্দর। কত সুন্দর তোমাদের গায়ের রং। কিন্তু আমি একটা বিষয় কিছুতেই মিলাতে পারছি না।

লাল গরুটি আগ্রহ নিয়ে বলল, কোন্ বিষয়টি? বাঘ জবাব দিল, ঐ যে কালো গরুটা। ওর গায়ের রং এতো বিশ্রী অথচ তোমরা কীভাবে তার সাথে বন্ধুত্ব করলে কিছুতেই বুঝতে পারছি না।

বাঘের এমন আন্তরিকতাপূর্ণ কথায় লাল ও সাদা গরুর মধ্যে সংশয় দেখা দিলো। বাঘ এটা বুঝতে পেরে আরো কিছু মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে লাগল যার ফলে লাল ও সাদা গরুর মধ্যে কালো গরুর ব্যাপারে একটা স্পষ্ট ঘেন্নার সৃষ্টি হলো। আর অল্প সময়ের মধ্যেই বাঘ তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হলো। বাঘ এ সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। পরদিন সে কালো গরুকে একা পেয়ে মনের সুখে হত্যা করে উদরপূর্তি করল।

এরপর কিছুদিন অপেক্ষা করে সে আবার কৌশল আঁটল। এবার সুযোগ মতো সাদা গরুকে বলল, তোমার গায়ের রং কত সুন্দর। সাদা হচ্ছে শুভ্রতার প্রতীক, বিশুদ্ধতার প্রতীক, ন্যায়ের প্রতীক, নেতার প্রতীক। তুমি হবে বনের রাজা। কারণ রাজা হবার মতো যোগ্যতা একমাত্র তোমারই আছে। তুমি কেনো ও রকম একটা লাল ক্ষ্যাত রংয়ের গরুর সাথে বন্ধুত্ব করে চলবে? এটা কী তোমার মানায়? শোনো, আজ থেকে তুমিই হবে বনের রাজা আর আমরা সব তোমার গোলাম। কিন্তু শর্ত তুমি ঐ লাল ক্ষ্যাতটাকে সঙ্গে রাখতে পারবে না। একজন রাজার জন্য এটা মানায় না।

সাদা গরুটা ঘাড় ঘুড়িয়ে একবার নিজেকে ভালো করে দেখে নিলো। তারপর মনে মনে চিন্তা করল, ঠিকই তো বলেছে বাঘটা। এর আগে এতো সুন্দর করে কেউ তো আমার প্রশংসা করেনি। আমিও তো কখনো খেয়াল করিনি যে, বনের রাজা হবার মতো যোগ্যতা আমার আছে। অবশেষে সে বাঘের কাছে একটা দিন সময় চাইল ভেবে দেখার জন্য।

রাতে আর কিছুতেই সাদা মিয়ার চোখে ঘুম আসে না। ঠিকই তো বলেছে বাঘটা। আমি কেনো লাল ক্ষ্যাতের সাথে বন্ধুত্ব করে আমার ভবিষ্যত নষ্ট করব? আমি যদি বনের রাজা একবার হতে পারি তাহলে ভবিষ্যতে আমার বংশধরদেরকে আর কোনো চিন্তা করতে হবে না।

যে কথা সেই কাজ। পরদিন থেকে সে একা চলতে শুরু করলো। এটা দেখে বাঘ চিৎকার করে শ্লোগান দিয়ে বসলো, সাদা মিয়া জিন্দাবাদ। বনের রাজা জিন্দাবাদ। বনের অন্য প্রাণীরাও দেখলো আর মুখ টিপে হাসতে লাগলো। কিন্তু কেউ কিছু বলার সাহস পেলো না।

তার কিছু পরেই লাল গরুটা যখন ঘাস খাবার জন্য বেরিয়েছে, বাঘটা তার ওপর আক্রমন করে মট্ করে ঘাড়টা ভেঙ্গে দিলো এক হেঁচকাতেই। বনের রাজা সাদা মিয়া দেখলো কিন্তু কিছু বললো না। মনে মনে ভাবলো, আপদ বিদায় হয়েছে। আমার রাজার গদি কেড়ে নিবার মতো ঝুঁকি শেষ হয়েছে।

রাতে সাদা মিয়া খুব দীর্ঘ ঘুম ঘুমালো। মনে হলো, এ জীবনে প্রথমবারের মতো এতো প্রশান্তিময় ঘুম হলো। পরদিন সকালে সে হেলে-দুলে বের হয়েছে ঘাস খাবার জন্য। পথেই দেখা হয়ে গেলো ঐ বাঘটার সাথে। কিন্তু একি। বাঘটার চেহারা এতো ভয়ংকর লাগছে কেনো? কেনো গতকালকের আন্তরিকতাপূর্ণ মুড দেখা যাচ্ছে না?

– এই ব্যাটা বলদ, শোন্। তাড়াতাড়ি মৃত্যুর জন্য তৈরি হ। আমি এখনই তোর ঘাড় মটকাবো।
– এটা আবার ক্যামন কথা? আমি না বনের রাজা।
– এ্যাঁহ্, বনের রাজা। বনের রাজা তো আমি। তুই আবার কোথাকার বনের রাজা? তোকে বনের রাজা বানিয়েছে কে? রাজ্য চালানোর মতো তোর কোনো বুদ্ধি আছে?
– কি বলছো তুমি এসব? তুমিই না আমাকে বনের রাজা বলে ঘোষণা দিয়েছিলে?
– হ্যাঁ, দিয়েছিলাম। তা নাহলে তো তুই আমাার কথা বিশ্বাস করতিস না। আর তোরা একত্রে থাকলে আমিও তোদেরকে মারতে পারতাম না।

কথা শেষ হতে না হতেই এক থাবা দিয়ে বাঘ সাদা গরুটার ঘাড় ভেঙ্গে মুখে তুলে নিরুদ্দেশ যাত্রা করলো।