ডেঙ্গুজ্বরের নতুন লক্ষণ সম্পর্কে জানুন। হেমোরেজিক থেকে ডেঙ্গু শকসিন্ড্রোম।

ডেঙ্গু জ্বর একটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগ। এডিস মশা ডেঙ্গু ভাইরাসের ভেক্টর বা বাহক।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগটি মারাত্মক রক্তক্ষরী রূপ নিতে পারে যাকে ডেঙ্গু রক্তক্ষরী জ্বর (ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার) বলা হয়।

এর ফলে রক্তপাত হয়, রক্ত অনুচক্রিকার মাত্রা কমে যায় এবং রক্ত প্লাজমার নিঃসরণ ঘটে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কখনোবা ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম দেখা দেয়।

ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোমে রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে কমে যায়। কয়েক প্রজাতির এডিস মশকী (স্ত্রী মশা) ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রধান বাহক। যেগুলোর মধ্যে এডিস ইজিপ্টি মশকী প্রধানতম।

ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ:

এবার ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বিগত বছরগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। দ্রুত গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন হচ্ছে। চার-পাঁচদিনের মাথায় হঠাৎ ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে চলে যাচ্ছে।

প্রতিবছর বর্ষাকালে, জুলাই-অক্টোবর ডেঙ্গুর প্রকোপ চললেও এবার জুন থেকেই ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়ে গেছে।

এ বছর ইতিমধ্যেই ডেঙ্গু ঢাকাসহ পুরো দেশবাসীকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। পরিবারে কারও ডেঙ্গু হলে আতঙ্ক নয়, চাই সতর্কতা ও সচেতনতা।

বেশির ভাগ ডেঙ্গু জ্বরই কয়েকদিন পর এমনি এমনিই সেরে যায়। প্যারাসিটামল, বিশ্রাম ও যথেষ্ট তরল ছাড়া এর কোনো চিকিৎসাই লাগে না।

তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে মোড় নেয়, যা রোগীর জীবনকে বিপন্ন করে তোলে।

ডেঙ্গু বিষয়টি মানুষ জানলেও এর যে গতি প্রকৃতিতে পরিবর্তন এসেছে তা হয়তো অনেকেই জানেননা। আক্রান্ত হওয়ার পরেও বুঝতে পারে না।

ডেঙ্গুজ্বরের নতুন লক্ষণ:

  • শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা, রাশ, গায়ে ব্যথার পরিবর্তে কাশি, পাতলা পায়খানা, বমির মতো নতুন ধরনের উপসর্গ দেখা যাচ্ছে।
  • জ্বর খুব একটা থাকে না। জ্বর বেশি না হলেও জ্বর জ্বর ভাব। টানা পাঁচ–ছয় দিন জ্বর থাকে।
  • শরীরে হালকা দুর্বলতা।
  • বমি বা শুধু মাথা ব্যাথা। বিভিন্ন অঙ্গে আঘাত হানা (যেমন কিডনি ফেইলিউর, যকৃতের সমস্যা, মায়োকার্ডাইটিস) বুক ও পেটে পানি জমার মতো জটিলতা।
  • রক্ত দিতে হয়। প্লাটিলেট কমে যায়। দ্রুত এসজিপিটি ও ক্রিয়েটিনিন বাড়তে থাকা, কারও কারও লাইপেজ বেড়ে যাওয়া।
  • যারা ডেঙ্গু জটিলতায় ভুগছেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা পানি শুন্যতায় ভুগছেন। পালস রেট খুবই কমে গিয়ে ডেঙ্গু শকসিনড্রোম হয়ে মারা যাচ্ছেন।
  • এখন ডেঙ্গুতে শরীর থেকে প্রচুর তরল বের হয়ে যায়। হালকা দুর্বলতা লাগে। হঠাৎ করে প্রেসার এতটা নেমে যাই যে, রোগী মারা যায়।

অনেকের ডেঙ্গু হওয়া সত্ত্বেও রক্তে ডেঙ্গু অ্যান্টিজেন নেগেটিভ থেকে যাওয়া। এ ধরনের নতুন বিশেষত্ব নিয়ে দেখা দিচ্ছে ডেঙ্গু।

তৃতীয় বা চতুর্থবারের মতো আক্রান্ত হওয়ার কারণেই তীব্রতার এ মাত্রা। তাই এ সময় জ্বর হলেই সতর্ক থাকা প্রয়োজন।

ডেঙ্গু জ্বরে করণীয় কি?

ডেঙ্গুজ্বর হলে আতঙ্কিত হবার কিছু নেই। রোগীর দিকে যথেষ্ট লক্ষ্য রাখুন। তাকে শতভাগ বিশ্রাম দিন।

প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ খাবার পানি, ডাবের পানি, খাবার স্যালাইন, ফলের রস ইত্যাদি রোগীকে খেতে দিন।

নিজেরা মাতবরি করে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক বা ব্যথানাশক খাওয়াবেন না। জ্বর সেরে গেলে অনেকেই সাবধানতা অবলম্বন কমিয়ে দেন।এটা ঠিক নয়।

জ্বর সেরে ওঠার সময়টুকুতে বেশি সাবধান থাকতে হবে। কারণ, এ সময়ই জটিলতাগুলো দেখা দিতে থাকে। তাই জ্বর কমার সঙ্গে সঙ্গে পেশাগত কাজে যোগ দেবেন না।

মাথা ঘোরা, চোখে অন্ধকার দেখা, দুর্বল লাগা রক্তচাপ কমে যাওয়ার লক্ষণ।

সবসময় মনে রাখবেন যে, পালস প্রেশার ২০–এর নিচে মানে ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের দিকে মোড় নিচ্ছে।

প্লাটিলেট এক লাখের নিচে নামলে বা হিমাটোক্রিট পরিবর্তন হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন, ৫০ হাজারের নিচে নামলে হাসপাতালে ভর্তি হোন।

কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি হলে প্লাটিলেট দিতে হবে, এমন কোনো কথা নেই।

এ ধরনের ডেঙ্গুতে প্লাজমা লিকেজ হয় (প্লাজমা শিরার বাইরে বেরিয়ে আসে)।

তাই সতর্কতার সঙ্গে স্যালাইন ব্যবহার করতে হয়। এ জন্যই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া।

এছাড়া অনেক বমি, রক্তপাত, রক্তচাপ কমে গিয়ে দুর্বল অনুভব করা, প্রচণ্ড পেটব্যথা, অতিরিক্ত অস্থিরতা, হাত–পা শীতল হয়ে আসা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিলে রোগীকে হাসপাতালে নিন।

কেন ডেঙ্গু হেমারেজিক ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়:

এটা এখনও পুরোপুরি পরিষ্কার নয় যে, কেন  মানুষ ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভার ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়।

সর্বাধিক গ্রাহ্য অনুমান হ’ল অ্যান্টিবডি-নির্ভরতা বৃদ্ধি বা antibody-dependent enhancement (ADE)। ADE-র পিছনের কলাকৌশল অস্পষ্ট।

মনে করা হয় যে, যার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যত বেশি তার ডেঙ্গু হেমোরেজিক বা শক সিনড্রোম-এর সম্ভাবনা ততো কম।

ডেঙ্গু ভাইরাসের কোন স্বীকৃত টিকা ভ্যাকসিন নেই। সুতরাং প্রতিরোধ নির্ভর করে জীবাণুবাহী মশা নিয়ন্ত্রণ এবং তার কামড় থেকে সুরক্ষার উপর।

রোগের লক্ষণের উপর চিকিৎসা নির্ভর করে, বাড়িতে নিয়মিত দেখাশোনার সঙ্গে ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপি থেকে শুরু করে হাসপাতালে ভর্তি করে ইন্ট্রাভেনাস থেরাপি পর্যন্ত।