ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রাকৃতিক উপায়।
রক্তে অতিরিক্ত শর্করা অর্থাৎ ডায়াবেটিস আধুনিক সভ্যতার সাথে তালমিলিয়ে বেড়েই চলেছে। আধুনিক সভ্যতার সাথে তালমেলাতে গিয়ে আমরা একটু বেশি আধুনিক হয়ে পড়ছি ভুলে যাচ্ছি পরিশ্রমের কথা। তাই তো অসুখ বিসুখ আমাদের শরীরে বাসা বেঁধে চলেছে।
বর্তমানে প্রায় প্রতেকটি ঘরে একজন করে ডায়াবেটিস রোগী দেখা যায়। বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৭০ লক্ষ বলছে ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফাউন্ডেশন। কিন্তু যারা আক্রান্ত তাদের ৫৭ শতাংশই জানেন না যে তাদের ডায়াবেটিস রয়েছে।
আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন বলছে, ডায়াবেটিস এমনই একটি রোগ, যা কখনো সারে না। কিন্তু এই রোগকে সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
অতিরিক্ত ডায়াবেটিস যেমন সমস্যা তেমন কমে গেলেও সমস্যা। তাই আমাদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে পারি। নিচে সে পদক্ষেপগুলো দেওয়া হলো-
রক্তের শর্করা মাত্রা কমানোর প্রাকৃতিক উপায়
নিচে ডায়াবেটিস (diabetes) নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রাকৃতিক উপায়গুলো দেওয়া হলো –
হাঁটা বা ব্যায়াম:
ব্লাড সুগার বা ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে নিয়মিত ব্যায়াম বা হাঁটা মহৌষধ হিসাবে কাজ করে।
নিয়মিত ২৫-৩০ মিনিট হাঁটলে বা ব্যায়াম করলে সুগার নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। নিয়মিত ব্যায়াম আমাদের ওজন কমাতে এবং ইনসুলিন কর্মক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে।
ইনসুলিন কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির অর্থ রক্ত চিনির ব্যবহার করতে আরও সক্ষম হওয়া। ব্যায়াম পেশীকে শক্তিশালী এবং পেশী সংকোচনের জন্য রক্তে চিনির ব্যবহার করতে সহায়তা করে। এসব ব্যায়ামের মধ্যে যেমন: ভার ওজন উত্তোলন, দ্রুত হাঁটা, দৌড়, সাঁতার কাটা ইত্যাদি।
শর্করা নিয়ন্ত্রণ:
আমাদের দেহ শর্করা ভেঙ্গে গ্লুকোজে পরিণিত করে। এই গ্লুকোজকে কোষে পৌঁছে দেয় ইনসুলিন। যখন আমরা খুব বেশি শর্করা খাই বা ইনসুলিন ফাংশন নিয়ে সমস্যা হয় তখন এই প্রক্রিয়াটি ব্যর্থ হয় এবং রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বৃদ্ধি পায়।
আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন শর্করার পরিমাণ হিসাব করে গ্রহণের পরামর্শ দেয়।
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, হিসাব করে শর্করা গ্রহণের এই পদ্ধতি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণকে আরও উন্নত করতে পারে।
অনেক গবেষণা আরও দেখায় যে, একটি কম শর্করা ডায়েট ডায়াবেটিসের মাত্রা হ্রাস করতে করে।
প্রচুর পরিমাণে পানি খানঃ
পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান ডায়াবেটিসের মাত্রা ঠিক রাখতে সহায়তা করে। এটি আমাদের শরীরের ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধ করার পাশাপাশি আমাদের শরীরে যে অতিরিক্ত শর্করা থাকে তা প্রস্রাবের মাধ্যম বের করে আনতে সহায়তা করে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, যারা বেশি পরিমাণে পানি পান করেন তাদের রক্তের উচ্চ শর্করার মাত্রার ঝুঁকি কমে।
মনে রাখবেন যে, পানি এবং অন্যান্য নন-ক্যালোরিযুক্ত পানীয় সর্বোত্তম। চিনি-মিষ্টিযুক্ত পানীয় রক্তে গ্লুকোজ বাড়ায়, ওজন বৃদ্ধি করে এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
টেনশন করা ছাড়ুনঃ
স্ট্রেস বা অতিরিক্ত চিন্তা ডায়াবেটিসের উপর প্রভাব ফেলে। গ্লুকাগন এবং করটিসোলের মতো হরমোনগুলি রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ব্যায়াম, relaxation এবং ধ্যানমগ্ন স্ট্রেস কমাতে পারে।
ব্যায়াম এবং relaxation এর মতো যোগব্যায়াম স্ট্রেস হ্রাস ছাড়াও দীর্ঘস্থায়ী ডায়াবেটিসে ইনসুলিন নিঃসরণ সমস্যা সংশোধন করতে পারে।
ফাইবার গ্রহণ বৃদ্ধি করুন:
ফাইবার কার্ববোহাইড্রেট হজম এবং গ্লুকোজ শোষণকে ধীর করে দেয়। আমরা সাধারণত খাবার থেকে দুই ধরণের ফাইবার পাই: দ্রবণীয় এবং অদ্রবণীয়। উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ হলেও দ্রবণীয় ফাইবার ডায়াবেটিস কমানোর ক্ষেত্রে বেশি কাজ করে।
একটি উচ্চ ফাইবারযুক্ত ডায়েড রক্তে শর্করার পরিমাণ ঠিক রাখে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা হ্রাস করে টাইপ-1 ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে।
যে খাবারগুলিতে উচ্চ পরিমাণের ফাইবার থাকে যেমন- শাকসবজি, ফলমূল, এবং আস্ত শস্যদানা।
মহিলাদের জন্য দৈনিক ফাইবার গ্রহণের পরিমাণ প্রায় ২৫ গ্রাম এবং পুরুষদের জন্য ৩৮ গ্রাম।
নিম্ন গ্লাইসেমিক:
খাদ্যে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ জানার জন্য গ্লাইসেমিক ইনডেক্স খুবই কার্যকরী। যে খাবার গুলোতে গ্লাইসেমিক ইনডেক্সের মান খুব কম সেসব খাবার টাইপ 1 এবং টাইপ 2 ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তের শর্করার মাত্রা কমায়।
যেকোন খাবারের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স গুরুত্বপূর্ণ তবে শর্করা গ্রহণের পরিমাণটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্সযুক্ত খাবারগুলির মধ্যে রয়েছে সামুদ্রিক খাবার, মাংস, ডিম, মটরশুটি, মসুর ডাল, মিষ্টি আলু, ভুট্টা, বেশিরভাগ ফল।
সঠিক ঘুম:
সুস্বাস্থ্যের জন্য পর্যাপ্ত ঘুম খুবই প্রয়োজনীয়। কম ঘুম এবং কম বিশ্রাম রক্তের শর্করা এবং ইনসুলিন সংবেদনশীলতার উপর প্রভাব ফেলে।
ঘুম কম হলে হরমোন নিঃসরণ কমে যায়। এটি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ওজন কমাতে হবে:
একটি স্বাস্থ্যকর ওজন স্বাস্থ্যের উন্নতি করবে এবং ভবিষ্যতের স্বাস্থ্য সমস্যা রোধ করতে সাহায্য করবে। ওজন নিয়ন্ত্রণ ডায়াবেটিসের মাত্রাকে ঠিক রাখে এবং ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি কমায়।
এমনকি ওজন ৭% হ্রাস করা মানে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি ৫৮% পর্যন্ত কমে যায়। এটি ঔষুধের চেয়েও ভাল কাজ করে বলে মনে হয়।
মেথি বীজ খান:
মেথির বীজ দ্রবণীয় ফাইবারের একটি দুর্দান্ত উৎস। যা ডায়াবেটিসের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে।
অনেক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে মেথি কার্যকরভাবে ডায়াবেটিস হ্রাস করতে পারে। এটি গ্লুকোজের সহনশীলতা ভালো করতে সহায়তা করে।
মেথি পানিতে ভিজিয়ে রেখে আমরা মেথি ভিজানো পানি খেতে পারি। যদিও এটার স্বাদ ভালো না তারপরও এটা ডায়াবেটিসের অন্যতম নিরাপদ ভেষজ উদ্ভিদ হিসাবে বিবেচিত হয়। প্রতিদিন ২-৫ গ্রামের বেশি নয়।
দারুচিনি:
আমাদের রান্না ঘরের অতিপরিচিত মসলা দারুচিনির অনেক স্বাস্থ্য উপকারীতা রয়েছে। এটি ইনসুলিন প্রতিরোধে হ্রাস করে ইনসুলিনের কর্মক্ষমতা বাড়ায়।
গবেষণায় দেখা যায় যে, দারুচিনি রক্তে শর্করার পরিমাণ ২৯% পর্যন্ত কমিয়ে আনতে পারে।
দারুচিনি ডায়াবেটিস রোগীদের শরীরে ইনসুলিনের মতো কাজ করে। তবে অবশ্যই পরিমাণ মতো খেতে হবে।
অ্যাপল সিডার ভিনেগার:
আপেল সিডার ভিনেগার স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী। এটি ডায়াবেটিসের মাত্রা ঠিক রাখে। ভিনেগার দেহের ইনসুলিন কর্মক্ষমতা বাড়ে।
৮ আউন্স পানিতে ২ চা চামচ আপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে খেতে হবে। তবে রক্তে শর্করা কমানোর জন্য যদি ঔষুধ খান তবে আপেল সিডার ভিনেগার গ্রহণের আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন।
আমরা নিজেরাই একটু সতর্ক হলে ডায়াবেটিসের মতো রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি। প্রতিদিন মেপে মেপে পরিমাণ মতো খাবার খেতে হবে। বাইরের অর্থাৎ রেস্টুরেন্টের খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। নিয়মিত ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে হবে। তবে ডাক্তারের পরামর্শ জরুরী এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ডায়াবেটিসের ঔষুধ গ্রহণ করতে হবে।