ওষুধ ছাড়া প্রাকৃতিক উপায়ে কিভাবে উচ্চ রক্তচাপ কমাবেন।

উচ্চ রক্তচাপকে “সাইলেন্ট কিলার” বলা হয়। উচ্চ রক্তচাপে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোনও লক্ষণ থাকে না। এটি হার্টের রোগ এবং স্ট্রোকের জন্য একটি বড় ঝুঁকি।

যুক্তরাষ্ট্রে মানুষের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ উচ্চ রক্তচাপ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তিনজন প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রায় একজনের মৃত্যু উচ্চ রক্তচাপ এর কারণে হয়ে থাকে।

উচ্চ রক্তচাপ কি?

আমাদের হার্ট প্রতিনিয়ত রক্ত পাম্প করতে থাকে শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রক্ত পৌঁছে দেওয়ার জন্য। এটি প্রতিদিন প্রায় এক লক্ষ বার পাম্প করে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত ধমনীর মধ্যে দিয়ে সমগ্র শরীরে পৌঁছে দেয়।

রক্ত ধমনীর মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় বাধাপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু রক্ত ধমনীর মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় যদি স্বাভাবিকের থেকে বেশি বাধাপ্রাপ্ত হয় তাহলে তাকে উচ্চ রক্তচাপ বলে। দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপ থাকলে হার্টের নানা রকম সমস্যা হতে পারে।

সাধারণত স্বাভাবিক রক্তচাপ বলতে আমরা 80 mmHg থেকে 120 mmHg বুঝি। রক্তচাপ যদি 120 mmHg থেকে 140 mmHg এর মধ্যে হয় তাহলে তাকে উচ্চ রক্তচাপের পূর্ব অবস্থা বলা হয়।

রক্তচাপ যদি 140 mmHg এর বেশি হয় তখন তাকে আমরা উচ্চ রক্তচাপ বলি।

blood pressure chart

উচ্চ রক্তচাপের কিছু ফ্যাক্টর আছে যেগুলো আমরা কন্ট্রোল করতে পারি না যেমন বয়স, জেনেটিক ইত্যাদি। কিন্তু কিছু ফ্যাক্টরি আছে যা আমরা চাইলেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি যেমন শরীর চর্চা, খাদ্য। আসুন কিছু খাবার সম্পর্কে জেনে নিই যেগুলো উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।

উচ্চ রক্তচাপের তেমন কোন লক্ষণ প্রকাশ পায়না। কিন্তু হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, মানসিক ভারসাম্যহীনতা এবং কিডনি নষ্ট হওয়ার মত মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ওষুধ আছে কিন্তু তার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। তবে ওষুধ ছাড়াও কিছু ঘরোয়া উপায়ে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা কার্যকর উপায়

নিচে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা কার্যকর উপায়গুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো –

নিয়মিত ব্যায়াম:

২০১৩ সালের একটি গবেষণায়, যেসব প্রাপ্ত বয়স্করা ব্যায়াম করেন তাদের রক্তচাপকে গড়ে ৩.৯% সিস্টোলিক এবং ৪.৫% ডায়াস্টোলিক কমেছিল। প্রতিদিন ৩০ মিনিট ব্যায়াম রক্তচাপ কমিয়ে রাখতে সাহায্য করে।

ব্যায়ামের সময় হৃদপিণ্ড শক্ত হয় এবং পাম্প করতে চাপ কম লাগে যা আর্টারির প্রেশার কমিয়ে উচ্চ রক্তচাপ কমায়। দিনে ১০,০০০ পদক্ষেপ হাঁটুন এটি রক্তচাপকে হ্রাস করতে পারে।

আঁশযুক্ত খাবার বেশি খান:

সবজি এবং ফলমূল শরীরের জন্য উপকারী। এগুলো রক্তে কোলেস্টেরলও কমায়। দ্রবণীয় আঁশ পরিপাক নালি থেকে স্পঞ্জের মতো কোলেস্টেরল শুষে নেয়। শিম, বার্লিতে প্রচুর আঁশ থাকে।

মদ্যপান পরিহার করুন:

অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় পান শরীরের জন্য ক্ষতিকারক। হার্ট সুস্থ্য রাখতে মদ সেবন থেকে বিরত থাকতে হবে।

ওজন কমান:

বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ওজনের দিকে খেয়াল না রাখলে এবং স্বাভাবিকের চেয়ে ওজন বেশি হলে নানা স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যদি আপনার ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে ওজন বেশি হয় তবে ওজন কমানো রক্তচাপকে হ্রাস করতে পারে।

২০১৬ সালের বেশ কয়েকটি গবেষণার পর্যালোচনাতে দেখা গেছে যে, ওজন হ্রাস করার ডায়েট রক্তচাপকে গড়ে ৩.২ মিমি এইচজি ডায়াস্টোলিক (mm Hg diastolic) এবং ৪.৫ মিমি এইচজি সিস্টোলিক (mm Hg systolic) কমায়।

চিনি এবং পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ কমান:

অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা যায় যে, ডায়েটে চিনি এবং পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট কমানো ওজন হ্রাস করতে এবং রক্তচাপ কমাতে সহায়তা করতে পারে।

২০১০ সালের একটি গবেষণায় লো-কার্বোহাইড্রেট যুক্ত ডায়েটকে কম ফ্যাটযুক্ত ডায়েটের সাথে তুলনা করে। উভয় ডায়েট ওজন হ্রাস করে, তবে লো-কার্বোহাইড্রেট যুক্ত ডায়েট রক্তচাপ কমাতে অনেক বেশি কার্যকর ছিল।

অতিরিক্ত চাপ কমান:

আমরা কম বেশি সবাই মানসিক চাপের মধ্যে থাকি। অতিরিক্ত মানসিক চাপ উচ্চ রক্তচাপ বাড়ানোর অন্যতম প্রধান কারণ। তাই মানসিক চাপ বা স্ট্রেস হ্রাস করতে শ্বাস প্ৰশ্বাসের ব্যায়ম করুন, হাঁটুন, বই পড়ুন।

প্রতিদিন গান শুনলে সিস্টোলিক রক্তচাপ হ্রাস পেতে দেখা গেছে। এছাড়া যোগ ব্যয়াম এবং ধ্যানও চাপ হ্রাস করার ভাল উপায়।

বেশি পরিমাণে পটাসিয়াম খান:

পটাসিয়াম গ্রহণ বাড়ানো এবং সোডিয়াম গ্রহণ কমানো রক্তচাপকে হ্রাস করতে পারে। পটাসিয়াম লবণের প্রভাবকে কমিয়ে দেয় এবং রক্তনালীগুলিতে উত্তেজনা হ্রাস করে।

তবে পটাসিয়াম সমৃদ্ধ ডায়েট কিডনি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের পক্ষে ক্ষতিকারক হতে পারে, তাই পটাসিয়াম গ্রহণ বাড়ানোর আগে ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।

লবণ কম খান:

ডায়েটে অতিরিক্ত লবণ আসে প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং রেস্তোঁরার খাবার থেকে। প্রক্রিয়াজাত খাবারগুলো মাংস, পিজা, চিপস এবং অন্যান্য প্রক্রিয়াজাত স্ন্যাক্স।

উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে কাঁচা লবণ খাওয়া যাবে না। আর রান্নাতেও যতটা সম্ভব লবণ কম দিন।

অতিরিক্ত লবণ রক্তে মিশে সোডিয়ামের মাত্রা বাড়ায় এবং দেহে সোডিয়ামের ভারসাম্য নষ্ট করে। ফলে রক্তচাপ হু হু করে বাড়তে থাকে। কিডনির উপরেও এর যথেষ্ট প্রভাব পড়ে।

ধূমপান বন্ধ করুন:

ধূমপান বন্ধ করা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল। ধূমপান রক্তচাপের তাৎক্ষণিক বৃদ্ধি করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে, তামাকের রাসায়নিক রক্তনালীরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং ধমনী সংকুচিত করে যা রক্তচাপ বৃদ্ধি করে। শক্ত ধমনী উচ্চ রক্তচাপের কারণ হয়।

স্বাস্থ্যকর উচ্চ প্রোটিনযুক্ত খাবার খান:

২০১৪ সালে একটি দীর্ঘমেয়াদী সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা বেশি পরিমাণে প্রোটিন খেয়েছেন তাদের উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কম থাকে।

যারা প্রতিদিন গড়ে ১০০ গ্রাম প্রোটিন খেয়েছিলেন তাদের জন্য লো-প্রোটিনযুক্ত ডায়েটের তুলনায় উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার ঝুঁকি ৪০% কম ছিল।

উচ্চ-প্রোটিনযুক্ত খাবারের মধ্যে রয়েছে: মাছ, ডিম, মুরগির বুকের মাংস, মটরশুটি এবং মসুর ডাল, বাদাম যেমন চিনাবাদাম, ছোলা পনির ইত্যাদি।

ক্যাফিন গ্রহণ সীমিত রাখুন:

ক্যাফিন আপনার রক্তচাপ মাত্রা বাড়তে পারে। আপনার রক্তচাপ মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে আপনার ক্যাফিন জাতীয় খাবার খাওয়া সীমিত করুন।

ডার্ক চকলেট খান:

ডার্ক চকোলেটের ফ্ল্যাভ্যানল শরীরে নাইট্রিক অক্সাইড উৎপাদন করে। নাইট্রিক অক্সাইডের ফলে রক্তনালীগুলি প্রশস্ত হয়, যা রক্ত প্রবাহকে উন্নত করে এবং রক্তচাপকে হ্রাস করে।

রেফারেন্স: