একজন পটুয়ার কথা।
একজন পটুয়ার কথা
—————————
১৯৪৫ সাল। পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে সারা বাংলায় ব্যায়াম ও শরীরচর্চা প্রতিযোগিতার খবর। তাতে প্রথম হয়েছেন একজন শিল্পী। ছবি আঁকার স্কুলে পড়েন তিনি। তিনি “মিস্টার বেঙ্গল” হয়েছেন। পত্রিকায় ছবি বের হলো। চারদিকে হইচই পড়ে গেল। এভাবে যিনি সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি আর কেউ নন। তিনি শিল্পী কামরুল হাসান।
তারপর অনেক দিন কেটে গেল।
১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধের বছর। পাকিস্তানি সেনাশাসন ইয়াহিয়া ক্ষমতায়। তাঁর হুকুমেই বাংলাদেশে নির্মম গণহত্যা হয়। তার চেয়ারাকে দানবের মতো করে আঁকলেন তিনি। বাংলাদেশের মানুষ আবার তাঁকে নতুনভাবে জানতে পারল। ইনি সেই শিল্পী কামরুল হাসান। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার চূড়ান্ত নকশা করেছেন তিনি।
তাঁর জন্ম কলকাতায়। বাড়ি বর্ধমান জেলার নারেঙ্গা গ্রামে। বাবার নাম মোহাম্মদ হাশিম। মায়ের নাম আলিয়া খাতুন।
ছোটবেলায় তিনি যে স্কুলে পড়তেন সেখানে ছবি আঁকা শেখানো হতো। এভাবে আঁকার প্রতি ঝোঁক সৃষ্টি হলো। বাবা তাঁকে ভর্তি করে দিলেন কলকাতা মাদরাসায়। কিন্তু তাঁর ইচ্ছা ছবি আঁকার স্কুলে পড়বেন। বাবা শেষে বাধ্য হয়ে তাঁকে ছবি আঁকার স্কুলে ভর্তি করলেন। বললেন, পড়ার খরচ তিনি দেবেন না।
পড়ার খরচ জোগাতে তিনি কাজ করেছেন পুতুলের কারখানায়।
তবে কামরুল কেবল ছবি আঁকা নিয়েই ব্যাস্ত ছিলেন না। পাশাপাশি শরীরচর্চা করেছেন। দেশসেবক তরুণদের সংগঠন ব্রতচারীদের দলে যুক্ত হয়েছেন। তাঁদের কাছ থেকে পেয়েছেন খাঁটি বাঙালি হওয়ার শিক্ষা।
শ্রদ্ধা করেছেন গ্রামের সাধারণ ছবি আঁকিয়েদের। এঁদের “পটুয়া” বলা হয়। নিজেকে “পটুয়া” বলে পরিচয় দিতে তাঁর গর্ব হতো। ব্রতচারীদের নিয়মনীতি তিনি মেনে চলেছেন। এর মধ্যে ছিল-
খিচুড়ি ভাষায় বলিব না।
ভুলেও ভুঁড়ি বাড়াইব না।
খিদে না থাকিলে খাইব না।
বিপদ বাধায় ডরিব না।
বিলাসিতা ভাব পুষিব না
রাগ পাইলেও রুষিব না।
দুঃখেও হাসিতে ভুলিব না।
দেমাগেতে মনে ফুলিব না।
অসত্য চাল চলিব না।
দৈবে ভরসা রাখিব না।
চেষ্টা না করে থাকিব না।
বিফল হলেও ভাগিব না।
ভিক্ষা জীবিকা মাগিব না
কথা দিয়ে কথা ভাঙ্গিব না।
ব্রতচারীদের এসব শিক্ষা তার মনে গেঁথে গিয়েছিল। সব সময় তিনি সহজ সরল জীবনযাপন করেছেন। কামরুল হাসান যুক্ত হয়েছিলেন শিশু-কিশোর সংগঠনের সঙ্গে। মুকুল ফৌজের নায়ক ছিলেন। কিশোরদের তিনি ব্যায়াম শেখাতেন। সহজ সরল জীবনের কথা তাদের বলেছেন। শিখিয়েছেন সততা। শিখিয়েছেন দেশকে ভালোবাসতে, মানুষকে ভালোবাসতে।
মানুষ ও দেশকে ভালোবাসতেন তিনি। সে জন্য ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। “তিন কন্যা”, “নাইওর”, “উঁকি” ইত্যাদি তাঁর ছবির নাম। আমরাও তাঁর মতো দেশকে ভালোবাসব। ছবিকে ভালোবাসব। মানুষকে ভালোবাসব।