লিভারের ক্যান্সার ও লিভারের চর্বি দূর করে যেসব খাবার।
লিভার আমাদের শরীরের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। লিভার শরীরের জন্য ৫০০ টিরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়াকলাপ বা কাজ করে থাকে। এর মধ্যে টক্সিন নির্মূল, প্রয়োজনীয় অণুগুলির সংশ্লেষণ এবং পরিশেষে ভিটামিন এবং শক্তি সঞ্চয় (চিনির আকারে)।
মানুষের স্বভাব কেন জানি পাল্টে যাচ্ছে। বোতলজাত, প্যাকেটজাত, প্রসেসেড-অতিরিক্ত চিনি, সোডা, লবণ, টেস্টিং সল্ট মেশানো খাবার খেয়ে নিজেদের শরীরের বারোটা বাজাচ্ছি যা লিভারের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলছে।
লিভার কার্বোহাইড্রেট ভেঙে ফেলার জন্য, গ্লকোজ বা শক্তি তৈরি করতে এবং শরীরকে বিষমুক্ত করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করে থাকে। এটি পুষ্টি সংরক্ষণ করে এবং পিত্ত তৈরি করে, যা খাবার থেকে পুষ্টি শোষণ ও সঠিকভাবে খাবার হজম করার জন্য প্রয়োজনীয়। লিভার রক্ষা করতে একজন ব্যক্তি সেবন করতে পারে এমন অনেকগুলি খাবার এবং পানীয় রয়েছে।
সুস্থ্য লিভার সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যাবশ্যক। লিভারের অসুস্থতা লিভারের রোগ (fatty লিভার, লিভার সিরোসিস), বিপাকীয় ব্যাধি এমনকি টাইপ-2 ডায়াবেটিস হতে পারে।
এই নিবন্ধে, আমরা লিভারের স্বাস্থ্যের জন্য সেরা খাবারগুলি, অঙ্গটির জন্য তাদের উপকারী প্রভাবগুলি এবং কিছু খাবার যেগুলো এড়িয়ে চলতে পারলে লিভারের জন্য মঙ্গল সেটা নিয়ে আলোচনা করবো।
লিভারের জন্য উপকারী যেসব খাবার
সামগ্রিকভাবে আঁশযুক্ত, অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস সমৃদ্ধ পুষ্টিকর খাবার লিভার বা যকৃতের জন্য উপকারী। তাহলে আসুন দেখা যাক, কি কি খাবার লিভারকে রাখবে পরিষ্কার ও সুস্থ্য :
কফি :
গবেষণায় দেখা গেছে কফি লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। গবেষকদের মতে কফি লিভারের স্বাস্থ্য ভাল রাখে কারণ এই পানীয় যকৃতে চর্বি জমা কমাতে সাহায্য করে। লিভারে চর্বি জমতে থাকলে তা পরবর্তিতে লিভারের রোগে পরিণত হয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে যারা কফি পান করেন তাদের লিভার ক্যান্সার ও প্রস্টেট ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি কম হতে পারে।
ল্যান্সেট অনকলজি জার্নালে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয় যে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশান (WHO) -এর “ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার” ২৩ জন আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীর সমন্বয়ে একটি দল গঠন করে। তাঁরা ১,০০০ এরও বেশী গবেষণা চালায় এবং প্রমাণ পায় যে কফি পান করলে ক্যান্সার হয় না বরং এটা লিভার ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি কমায়।
গ্রীন টি :
যদি আমরা শরীরের চর্বি কমায় এমন একটি খাদ্য তালিকা দেখি, দেখবো সেই তালিকায় গ্রীন টি আছে। গ্রীন টি মেটাবলিক রেট এবং পাচন তন্ত্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।নিয়মিত গ্রীন টি পান করলে শরীরে জমে থাকা অতিরিক্ত ক্যালরী কমাতে সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, গ্রীন টি শরীরের চর্বি কমাতে সাহায্য করে বিশেষ করে তল পেটের চর্বি।
জাম্বুরা (বাতাবিলেবু):
জাম্বুরা লিভারের জন্য উপকারি কারণ এতে আছে জারণরোধক বা এন্টিঅক্সিডেন্ট। জাম্বুরায় থাকা দু’ধরনের জারণরোধক নারিনজেনিন (naringenin) এবং নারিনজিন (naringin) প্রদাহ কমায় ও লিভারের কোষকে নিরাপদে রাখে। এছাড়া এগুলি অতি মাত্রায় কানেক্টীভ টিসু জন্মানো ও লিভারে চর্বি জমা রোধ করে।
রসুন:
রসুনের উপকারিতার কথা বলতে গেলে প্রথমে যে উপাদানটির কথা বলতে হয় সেটা হলো এলিসিন। এই “allicin”- এন্টিব্যাকটেরিয়াল, এন্টিভাইরাস, এন্টিফাংগাল এবং এন্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে কাজ করে ও শরীরকে সুস্থ্য রাখে। রসুনে বিদ্যমান সালফার একে এন্টিবায়োটিক প্রোপারটিস সরবরাহ করে থাকে। অ্যালিসিনের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্যের কারণে প্রতিদিন দৈনিক ভিত্তিতে রসুন গ্রহণ কলেস্টেরলের মাত্রা কমতে সহায়তা করে। আমাদের লিভার ও রক্তকে পরিশুদ্ধ করে।
আঙ্গুর:
গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজির ওয়ার্ল্ড জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে যে আঙ্গুর, আঙ্গুরের রস এবং আঙ্গুর বীজ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ যা প্রদাহ হ্রাস এবং লিভারের ক্ষতি রোধ করে লিভারকে সাহায্য করতে পারে। আঙ্গুর, বিশেষ করে লাল আঙ্গুরে আছে অনেক স্বাস্থ্যোপকারি উপাদান।
রেসভেরাট্রল (Resveratrol) নামের উপাদান লিভারের প্রদাহ কমায় এবং লিভারকে ফ্রী র্যাডিকেল দ্বারা ক্ষতি হওয়া থেকে রক্ষা করে। প্রতিনিয়ত রিযারভেট্রল গ্রহণ করলে এটা ক্যান্সারের ঝুঁকিও কমায়। নিয়মিত আঙ্গুর খাওয়া আপনার লিভারের জন্য ভাল। তবে লিভারের রোগ থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন কতটুকু আঙ্গুর আপনা খাওয়া উচিৎ।
জলপাই তেল:
অত্যধিক চর্বি খাওয়া লিভারের পক্ষে ভাল না তবে কিছু চর্বি লিভারের জন্য ভালো হতে পারে। গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজির ওয়ার্ল্ড জার্নালির সমীক্ষা অনুসারে, ডায়েটে জলপাইয়ের তেল অক্সিডেটিভ স্ট্রেস হ্রাস করতে এবং লিভারের কার্যকারিতা উন্নত করতে পারে।
টক দই :
সারাদিন আমরা যে, কত রকমের খাবার খাচ্ছি তা বলা মুশকিল। এছাড়া বুঝে হোক বা না বুঝে-বাইরের খোলা খাবারও আমরা খেয়ে থাকি প্রায়শ। ফলে হজমে গরমিল শুরু হয়ে যায়। তার ফলে পেটে ব্যাথাসহ পেটের নানা অসুবিধা দেখা দেয়। দইয়ে থাকে প্রচুর পরিমাণে প্রোবায়োটিক অর্থাৎ উপকারী অন্ত্র-বান্ধব ব্যাকটেরিয়া।
উদাহরণ হিসেবে ল্যাকটোব্যাসিলাস অ্যাসিডোফাইলাস নামক ব্যাকটেরিয়ার কথা বলা যায়। দইয়ের মাধ্যমে এই ব্যাকটেরিয়া মানুষের পৌষ্টিকতন্ত্রে পৌঁছয় ও খাদ্য হজমে সাহায্য করে। দই আমাদের হজম শক্তি বাড়িয়ে তোলে যার ফলে আমাদের শরীরের পরিপাক শক্তি বাড়ে এবং পেটের সমস্যা দূর হয়ে যায়। খাবার খাওয়ার পর দই খেলে তা খাবার পরিপাক হতে সাহায্য করে।
তৈলাক্ত মাছ :
ওয়ার্ল্ড জার্নাল অফ গ্যাস্ট্রোইন্টারোলজিতে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে তৈলাক্ত মাছ এবং মাছের তেলের সাপ্লিমেন্ট খেলে তা নন এলকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ (NAFLD) হওয়ার সম্ভাবণা কমায়।
তৈলাক্ত মাছে আছে প্রচুর ওমেগা-3 ফ্যাটি এসিড, যা ভাল চর্বি এবং এটা প্রদাহ কমায়। এই চর্বি বিশেষ করে যকৃতের জন্য অনেক উপকারি কারণ ওমেগা-3 লিভারে অতিরিক্ত চর্বি জমা বন্ধ করে লিভারে এনযাইমের মাত্রা ঠিক রাখে। গবেষণায় বলা হয়েছে সপ্তাহে ২ দিন বা তার বেশী তৈলাক্ত মাছ খাওয়া উচিৎ।
বাদাম :
বাদামে আছে প্রচুর ভাল চর্বি ও ভাইটামিন ই। এই উপাদানগুলি যেমন হৃদপিন্ডের জন্য ভাল, তেমনি এগুলি লিভারের জন্যও ভাল। একটি গবেষণায় ১০৬ জন নন এলকোহলিক ফ্যাটি লিভার রোগে (NAFLD) এ আক্রান্ত ব্যক্তির উপর ৬ মাস ধরে চালানো হয়। দেখা যায় বাদাম খাওয়ার ফলে অংশগ্রহনকারীদের লিভারে এনযাইমের উন্নতি হয়।
লিভারের জন্য ক্ষতিকর যেসব খাবার:
কিছু জিনিস রয়েছে যা লিভারের জন্য খারাপ হতে পারে যেমন ভারী মদ্যপান বা উচ্চ মাত্রায় ঔষুধ খাওয়া। লিভারকে সুস্থ্য রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিচে লিভারের জন্য ক্ষতিকর কয়েকটি খাবার সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
এলকোহল বা মদ:
অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় আমাদের পক্ষে খারাপ তা কোনও গোপন বিষয় নয়। লিভারের জন্য, অতিরিক্ত অ্যালকোহল খুব গুরুতর সমস্যা তৈরি করতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবনের ফলে অ্যালকোহলজনিত লিভার ডিজিজ বা লিভারের ব্যর্থতা দেখা দিতে পারে।
অ্যালকোহল পান করা লিভারের রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং দেহের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশটিকে অপূরণীয় ক্ষতি করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, গত এক দশকে ইংল্যান্ডে লিভারের রোগে মৃত্যুর ২৫% বৃদ্ধির প্রধান কারণ অ্যালকোহল।
টিনজাত পন্য:
ক্যান গোছানো খাবারগুলি সোডিয়াম দিয়ে ভরা হয় এটাও কোনও গোপন বিষয় নয়। সোডিয়াম কেবলমাত্র খাদ্য সংরক্ষণের জন্যই নয়, সস্তা খাবারের স্বাদকে আরও শক্তিশালী করতে ব্যবহৃত হয়।
সোডিয়ামের উচ্চ মাত্রার ব্যবহার আমাদের যকৃতের কোষের ক্ষতি করে থাকে। কিছু কিছু ক্যানড পণ্যতে মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট (এমএসজি), বিসফেনল এ (বিপিএ), বা অন্যান্য ক্ষতিকারক উপাদানগুলি থাকে।
ফাস্ট ফুড :
ফাস্ট ফুড, টিনজাত পণ্যগুলির অনুরূপ, ফাস্ট ফুডেও অন্য যেকোন ধরণের খাবারের চেয়ে বেশি তেল-চর্বি ও সোডিয়াম থাকে। পিজা, বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, হট ডগ-খেতে স্বাদ লাগলেও এগুলো আমাদের লিভারের ক্ষতি করে থাকে। আমরা সকলেই বার বার টেকআউট খাবার পছন্দ করি তবে নিয়মিত খুব বেশি খাওয়ার ফলে মারাত্মক পরিণতি হতে পারে। আসলে এটি হেপাটাইটিসের মতো আপনার লিভারেও একইরকম প্রভাব ফেলতে পারে।
লাল মাংস :
লাল মাংস প্রোটিনের একটি দুর্দান্ত উৎস। তবে এটিতে কোলেস্টেরল খুব বেশি পরিমানে থাকে। অত্যধিক লাল মাংস লিভারের রোগ, হেপাটোসেলুলার কার্সিনোমা এবং এমনকি ডায়াবেটিসের ঝুঁকির সাথে যুক্ত। বিশেষত, লাল মাংসে স্যাচুরেটেড ফ্যাট, অতিরিক্ত আয়রন, হেটেরোসাইক্লিক অ্যামাইনস এবং এন-নাইট্রোসো যৌগিক রয়েছে যা আমাদের জন্য খারাপ। যদি আমরা প্রচুর লাল এবং প্রক্রিয়াজাত মাংস খাই তবে এটা কমিয়ে ফেলতে হবে কারণ লাল এবং প্রক্রিয়াজাত মাংস আমাদের অন্ত্রের ক্যান্সারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুসারে প্রতিদিন ৫০ গ্রাম করে প্রসেসড রেড মিট খেলে তবেই কলোরেকটাল ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। শুধু তাই নয়, এই পরিমাণ রেড মিট যদি প্রতিদিন ফ্রাই করে খাওয়া হয়, তাহলে শুধু কলোরেকটাল নয়, সেই সঙ্গে প্যানক্রিয়াটিক এবং প্রস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও বৃদ্ধি পায়।