বারান্দায় রোদ্দুর। একটু গা ছেড়ে বসে সুন্দর সময় কাটানো মুহূর্ত জীবনে ভোলার নয়।
বারান্দা শব্দটি আমাদের বাঙালিদের কাছে খুব পরিচিত। বারান্দা শব্দটি কানে এলেই কিছুটা প্রশান্তি ছড়ায় মনে। ঋতুভেদে সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা বা রাত—প্রতিটি সময়ের সঙ্গে বারান্দার রয়েছে সুখস্মৃতি।
বারান্দা মানে চেয়ার বা বেঞ্চে বসে রোদ্দুর লাগানো। বারান্দা মানে খবরের কাগজ বা গল্পের বই হাতে নিয়ে চায়ের কাপে চুমুক। বারান্দা মানে কাপড়চোপড় ও অপ্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দিয়ে এলোমেলো করে রাখা। বারান্দা মানে ইট পাথরের বানানো বহুতল বিল্ডিংয়ের ভীড় ঠেলে একটুকরো নীল আকাশ দেখার সুযোগ।
শীতের রোদমাখা সকাল, বসন্তের বিকেল, গ্রীষ্মের বা গরমকালের রাত অথবা বর্ষার মুষলধারা বৃষ্টির মুহূর্তগুলো প্রিয়জনের সঙ্গে বা একা উপভোগ করার সবচেয়ে একান্ত একটি জায়গা।
শহুরে জীবনে বাড়ির সবচেয়ে স্বস্তির জায়গাটি হলো বারান্দা। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দীর্ঘ সময় ধরে ঘরে থাকায় বারান্দাতে প্রায়ই সময় কাটাতে হয়।
তবে প্রায়শই বাড়ির বারান্দাটিকে কাপড়চোপড় ও অপ্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দিয়ে এলোমেলো করে রাখা হয়। তা না করে যদি পরিষ্কার ও কিছু শৈল্পিক ছোঁয়া দেওয়া যায় তবে কাঠামোগত পরিবর্তন না করেই বারান্দার চেহারাটিকে পছন্দের রূপ দেওয়া সম্ভব।
ঘরের বারান্দাটি ছোট বা বড় যাইহোক এর মধ্যেই তা মনোরম, পরিপাটি ও স্বস্তিদায়ক করে তুলতে পারেন। বারান্দায় যদি সূর্যের আলো আসে, পাখির কলরব শোনা যায় কিংবা আকাশের নীল দেখা যায় তাহলেই যথেষ্ট।
বারান্দা শব্দটি কোন ভাষা থেকে এসেছে? বারান্দা শব্দটি পর্তুগীজ ভাষা থেকে এসেছে। পর্তুগিজ শব্দ varanda থেকে বারান্দা শব্দের উৎপত্তি। বারান্দাকে ইংরেজিতে railing বলে।
A veranda or verandah বা বারান্দা হলো রুমের সামনের porch বা করিডোর বা দীর্ঘ, খোলা ঘর যার উপরে ছাদ রয়েছে। এটিতে ছাদটি ধরে রাখা কলাম বা স্তম্ভগুলির একটি লাইন থাকে। বাইরের চারদিকে প্রায়শই রেলিং থাকে।
ব্যালকনি বনাম বারান্দা
বারান্দাকে কি ব্যালকনি বলা যায়?
না, বারান্দাকে ব্যালকনি বলা যায় না। অল্প একটু পার্থক্য রয়েছে। একটি বারান্দা বাড়ির Ground level বা স্থল স্তরে অবস্থিত একটি আচ্ছাদিত কাঠামো। এটি সাধারণত মূল ভবনের দুটি বা ততোধিক দিকের সাথে সংযুক্ত থাকে। অন্যদিকে, একটি ব্যালকনি একটি উঁচু প্ল্যাটফর্ম যা বিল্ডিংয়ের উপরের তলায় একটি নির্দিষ্ট ঘরের সাথে সংযুক্ত থাকে।
ঢাকা শহর বা বড় কোনো শহরের কাউকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়, বারান্দা কি? একটা বড় অংশ জবাব দেয় – বারান্দা হল কাপড় শুকানোর জায়গা। জবাবটা শুনে আমরা খুব দুঃখিত হই।
বর্তমান নগরজীবনে স্থান সংকুলানের সংকট এমনি দাঁড়িয়েছে যে, এখানে বারান্দার মত খোলা জায়গাকে ব্যবহার করা হয় শুধু মাত্র কাপড় শুকানোর জন্য অথবা পুরানো, অকেজো কোন জিনিস রাখার জন্যে। অথচ একটা সময় ছিল যখন পরিবারের সকলেই বারান্দায় দিনের কিছু অংশ কাটাতো।
মায়েরা আচার শুকাতেন, বাবারা খবরের কাগজ পড়তেন, বোনেরা চুল শুকাতো, বড় ভাইয়েরা লুকিয়ে রাতে সিগারেট খেতো। আমাদের জীবনধারার সাথে প্রকৃতি ও পরিবেশ যুগ যুগ ধরে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গ্রাম বাংলায় ঘর থেকে লোকে উঠানেই বেশি সময় কাটায়। সেই উঠানেরই শহুরে বিকল্প – বারান্দা।
বর্তমানের অপরিকল্পিত নগরায়ন, ভবন নির্মান পরিকল্পনার ত্রুটি অনেক ক্ষেত্রেই মানুষকে বারন্দা বিমুখ করেছে। তাছাড়া শহুরে জীবনের গতি বৃদ্ধি পেলেও, কমে যাচ্ছে একে অন্যের সাথে যোগাযোগ।
আর সেই সাথে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ইট পাথরের ভীড় ঠেলে এক টুকরো নীল আকাশ দেখার সুযোগ। অথচ আমরা চাইলে, আমাদের বাসার এই গুরুত্বপূর্ন অংশটিকে দৈনন্দিন জীবনের একটি অংশ হিসেবে তৈরী করে নিতে পারি। আপনার বারান্দাই হতে পারে, এই কংক্রীটের বন্দীশালায় এক চিলতে সুখ।
আপনার শখের কাজ গুলো বারান্দাতে বসেই করুন। এতে দিনের কিছুটা সময় খোলা বাতাসে কাটানো হবে। যোগ ব্যায়াম করতে পারেন, বই পড়তে পারেন, বাগান করতে পারেন, গলা সাধতে পারেন বা বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারেন।
এ কাজ গুলোর কোনটাতেই কারেন্টের প্রয়োজন হয় না, তাই বারান্দায় দিনের আলো থাকতে থাকতে সহজেই করা যায়। শখের জিনিস গুলো হাতের নাগালে রাখার জন্য দেয়ালে কিছু তাক লাগিয়ে নিতে পারেন। বারান্দায় আমরা অনেক জিনিস স্টোর করি, কিছু বাক্সে জিনিস গুছিয়ে রেখে তার উপর কুশন দিয়ে সহজেই বারান্দায় বসা যায়।
বারান্দায় আমরা কাপড় শুকাই, যা অবশ্যই একটি দরকারি কাজ। তাই বলে পুরো বারান্দা শুধুমাত্র কাপড় শুকানোর কাজে ব্যবহার না করে অন্যান্য প্রয়োজনেও ব্যবহার করা উচিত বলে আমরা মনে করি। তাই বারান্দায় লাগিয়ে নিন প্রয়োজন মত রিট্রাকটেবল ওয়াশিং লাইন বা ফোলডিং কাপড় শুকানোর র্যাক যা আপনি ব্যবহার শেষে সরিয়ে রাখতে পারবেন।
সন্ধ্যার পর বারান্দায় বসতে হলে বারান্দায় নেট লাগিয়ে নিন। গাঁদা ফুল গাছ ও তুলসী গাছ লাগাতে পারেন, মশা আসবে না। মাটির কয়েল দানিতে কয়েল বিকেল বেলা থেকে দিয়ে রাখলে মশার উপদ্রব কম হয়। এছাড়াও লেটুস, টমেটো, কারি পাতা, পুদিনা, ধনে ও মরিচ গাছ লাগাতে পারেন। শুধুমাত্র কাজের জিনিস ছাড়াও বারান্দাকে আপনি বিভিন্ন ভাবে সাজিয়ে নিতে পারেন। বারান্দার কর্নারে কিছু ঝোপ জাতীয় গাছ রাখতে পারেন।
টবদানি বা স্ট্যান্ডে এই ধরনের ঝোপ জাতীয় গাছ রাখতে পারেন। সাথে যুক্ত করে দিতে পারেন কিছু ব্যাটারি চালিত রঙিন লাইট। রাখতে পারেন একটা ছোট্ট এ্যাকুরিয়ামও। এটা একদিকে যেমন আপনার বারান্দার সৌন্দর্য বাড়াবে, আবার বাড়িতে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় হবে সেলফি তোলার একটি চমৎকার জায়গা।
আবার অনেকেই বলবে শহুরে জীবনের একটুখানি খোলা আকাশের সন্ধান পাওয়া যায় এই বারান্দায়। তাই তো মনের মতো ফ্ল্যাট খুঁজতে গিয়ে সবাই প্রথমেই প্রাধান্য দেন বাড়ির এই অংশের প্রতি। এমনকি অনেকের কাছে শোবার ঘরের চেয়ে বারান্দা যেন বেশি জরুরি।
তাই হয়তো বলতে শোনা যায়, আর কিছু থাকুক না থাকুক, বাড়ির যেকোনো অংশে এক চিলতে বারান্দা থাকা চাই-ই চাই। কারণ, শখের বারান্দায় রাখা আরামকেদারায় পিঠ এলিয়ে কিছুটা সময় কাটানো যায় একেবারে নিজের মতো। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বারান্দার কাঠামো এবং চেহারায় আমূল পরিবর্তন এসেছে।
পুরোনো দিনের বাড়িগুলোতে দেখা যেত কাঠের নকশা করা রেলিংয়ে ঘেরা লম্বা, বড় পরিসরে খোলামেলা বারান্দা, যা আজকাল আর চোখে পড়ে না খুব একটা। সে জায়গা দখল করেছে ব্যালকনি। কারণ, আধুনিক ফ্ল্যাটগুলোতে মনের মতো আয়তনের বারান্দা তৈরি করার স্বাধীনতা নেই। কারণ, বাড়ির আয়তনের সঙ্গে সঙ্গে ছোট হয়ে এসেছে বারান্দার পরিসরও। নামে এসেছে পরিবর্তন, সঙ্গে সাজসজ্জাতেও।
শহরে যাঁরা বসবাস করেন, তাঁদের কর্মব্যস্ততা আর সময়ের অভাবে ব্যালকনিগুলো অনেকটাই অবহেলিত। কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যাবে, সাধারণত বারান্দা বা ব্যালকনি বাড়ির সামনের দিকেই থাকে।
সুতরাং, বাইরে থেকে দেখতে গেলে কিন্তু বারান্দা সবার আগে নজর আসে। তাই যত্ন নিয়ে মনের মতো সাজানো উচিত জায়গাটি। আবার অনেক কম সময়ের মধ্যেই জায়গাটির পুরো চেহারা পাল্টে ফেলা সম্ভব। শুধু পছন্দমতো আসবাব এবং এক্সেসরিজ নির্বাচন করা চাই।
বারান্দা সাজাতে প্রথমেই প্রয়োজন ছোট ছোট টবে রঙিন ফুল বা পাতারগাছ। পাতাবাহার, মানিপ্ল্যান্ট, ফরচুন ট্রি, বনসাই ইত্যাদি জায়গাটির শোভা বাড়াবে। আজকাল ঝোলানো টব বা পট পাওয়া যায়। এগুলোও দেখতে সুন্দর।
যাঁরা মাটি বা প্লাস্টিকের টব পছন্দ করেন না, তাঁরা চিরাচরিত টবের পরিবর্তে সিরামিক, তামা, পিতল বা ক্লের তৈরি টব রাখতে পারেন। প্রাকৃতিক লুক আনতে চাইলে বারান্দার গ্রিল বা পিলার বরাবর লতানো গাছ দিয়েও সাজানো যায়। এতে বারান্দায় সবুজের পরিমাণও বাড়বে।
ঝোলানো শোপিস বা উইন্ডচাইমসও রাখা যেতে পারে। বই, খবরের কাগজ বা ম্যাগাজিন পড়ার অভ্যাস থাকলে রাখতে পারেন ছোট কাপবোর্ড। এতেও বারান্দার সৌন্দর্য বাড়বে। কাপবোর্ডের ওপরে ছোট ক্যান্ডেল বোল রাখলেও অনেক পরিপাটি লাগবে। বোলের ভেতর ছোট ছোট রঙিন পাথর, ফুল আর পানি রাখুন। সন্ধ্যাবেলা মোম জ্বালালে, বারান্দাময় একটা উষ্ণ আবহ তৈরি হয়। কাপবোর্ডের ওপর ফোটো ফ্রেমও মানায়।
বারান্দায় বসার ব্যবস্থা থকাতেই হবে। তবে তা হতে হবে আয়তন ও জায়গা বুঝে। যেমন ছোট বারান্দার ক্ষেত্রে কয়েকটা বেতের মোড়া বা কাঠের টুল রাখলেই যথেষ্ট। অনেকে গাছের গুঁড়ি রং করেও রাখে। জায়গায় বেশি থাকলে একটা ছোট সেন্টার টেবলও রাখা যেতে পারে। আর ব্যালকনি বড় হলে সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট হতে হবে সঠিক। নাহলে এলোমেলো দেখাবে।
বেতের সোফা সবচেয়ে নান্দনিক। অবশ্য লোহা বা কাঠ পছন্দ হলে, এসবের আসবাবও রাখা যেতে পারে। সঙ্গে রাখুন মাঝারি আকারের কয়েকটা কুশন। একটু উজ্জ্বল বা আধুনিক কুশন কভার বাছাই করুন। এতে সহজেই ব্যালকনির আমেজে বেশ বড়সড় পরিবর্তন আসে। বড় ব্যালকনিতে রাখা যায় দোলনা। চাইলে এর বদলে আরামকেদারা বা সুইং চেয়ারও রাখা যায়।
ব্যালকনির সাজ নির্ভর করে রুচি এবং সময়ের ওপর। অর্থাৎ, আপনি কতটা সময় এবং কীভাবে বারান্দায় সময় কাটাবেন, সে অনুযায়ী আসবাব নির্বাচন করুন। যদি আপনি বারান্দায় বসে গান শুনতে বা বই পড়তে পছন্দ করেন। তবে সে ক্ষেত্রে দেয়ালজুড়ে কাঠের র্যাক বানিয়ে তাতে পছন্দের বই এবং মিউজিক সিস্টেমও রাখতে পারেন।
অযথা ধুলার হাত থেকে বাঁচতে হলে র্যাকগুলো ঢেকে রাখাই ভালো। আবার বারান্দা খোলা হলে, রোদ-বৃষ্টি থেকে বাঁচতে স্লাইডিং বা ফ্রেঞ্চ ডোরের ব্যবস্থাও রাখতে পারেন। আবার নান্দনিক উপস্থাপনায় বাঁশের ড্র-স্ট্রিং পর্দাও বেশ ভালো। তবে যেভাবেই সাজান না কেন, খেয়াল রাখতে হবে বারান্দা যেন খোলামেলাই থাকে। কোনোভাবেই একে আবদ্ধ করে রাখা উচিত হবে না।
আমাদের অনেকের শহুরে জীবনে স্বস্তি খুবই বিরল। একটি সাজানো গোছানো বারান্দা হতে পারে কংক্রিটের জংগলে একটু স্বস্তি, মুক্ত হাওয়া উপভোগের স্থান কিংবা আড্ডার জায়গা। সঠিক পরিকল্পনায় গোছানো একটি বারান্দা আপনার বাসার আকর্ষন আপনার কাছে বাড়িয়ে তুলবে বহুগুন।