নিয়মিত অল্প একটু ঘি যৌবন ধরে রাখতে, সমবয়সীদের তুলনায় আপনার ত্বক উজ্জ্বল দেখাবে।

দুধ থেকে আমরা ঘি তৈরি করে থাকি। আমাদের বাঙালি সমাজে গরু ও মহিষের দুধ থেকে মূলতঃ ঘি তৈরি হয়ে থাকে। হালকা হলুদ বা হলুদাভ বাদামি, কখনো দানা যুক্ত ‘ঘি’ দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি ঘি নামটা শুনলেই যেন মনটা ভরে যায়।সকাল বা দুপুরবেলা গরম ভাতে একটু ঘি হলেই যেন পুরো ভাতটা নিমিষেই খাওয়া হয়ে যায়।

সুন্দর মায়াময় গন্ধে পরিবেশটা রাজকীয় হয়ে যাই। ভাতের সঙ্গে ঘি মিশিয়ে খেলে শরীরে দীর্ঘক্ষণ শক্তি থাকে ও শরীর গরম থাকে। তাই বলা হয়, শীতকালের আদর্শ খাবার হলো ঘি বা দেশি ঘি।

ঘি-তে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদান আপনার ত্বককে ভেতর বাহির উভয় দিক থেকে উজ্জ্বল করতে সহায়তা করে।

ঘি এর ব্যবহার সেই প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। বিশেষ কিছু খাবারের স্বাদ বাড়াতে যেমন: পোলাউ, বিরিয়ানি, পায়েস, হালুয়া, রোস্ট, রেজালা, কালিয়া, কাচ্চি বিরিয়ানীসহ আরো অন্যান্য খাবার তৈরিতে ঘিয়ের প্রয়োজন হয়।

ঘি খেতে তো অনেকেই পছন্দ করেন আবার অনেকেই অপছন্দ করেন। কিন্তু অনেকেই জানেন না ঘিয়ের উপকারিতা সম্পর্কে। ঘি তখনই শরীরের ক্ষতি করে, যখন তা অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া হয়। তাই ঘিয়ের উপকারিতা পাওয়ার জন্য নিয়ন্ত্রণ মেনে ঘি খেতে হবে।

ঘি আসলে কী?

ইংরেজিতে ঘিকে বলা হয় ক্লারিফায়েড বাটার। এতে রয়েছে ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশ চর্বি। বাকি ০১ শতাংশ জলীয় উপাদান, চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিন ও দুধের পোড়া অংশ। ঘি মূলত সম্পৃক্ত চর্বি তাই এটি বাইরের তাপমাত্রাতেই সংরক্ষণ করা যায়।

ঘি যেভাবে তৈরি হয়?

সাধারণত গরুর দুধ থেকেই ঘি তৈরি করা হয়। দুধ থেকে বাটার বা মাখন বানাতে হবে। তারপর সেই মাখন ভালোভাবে ফেটে নেওয়ার বা মথিত করার পর জ্বাল দিলে ঘি হবে। ঘরেও এভাবেই ঘি বানানো হয়। তবে অনেকেই দুধের সর থেকে ঘি তৈরি করেন। দীর্ঘদিন ধরে সর জমা করে তারপর সেটি বেটে বা ব্লেন্ড করে জ্বাল দিলে ঘি হয়।

ঘিয়ের বিস্ময়কর উপকারিতা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক —

ত্বক উজ্জ্বল করে:

ঘি- তে ভিটামিন “A”,”D”,”E”,”K” বিদ্যমান। ভিটামিন “A ” (হাড়,দাঁত,immune health), ভিটামিন “D “(ক্যালসিয়াম শোষণে সাহায্য ), ভিটামিন “E “( চোখ ও ব্রেইন), ভিটামিন “K “(blood clot সারাতে ) সাহায্য করে থাকে। চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিন ও ফ্যাটি অ্যাসিডগুলি আপনার ত্বককে ভেতর থেকে উজ্জ্বল করে।

আদিকাল থেকেই ঘি বিভিন্ন বিউটি কেয়ার রিচার্সের প্রধান অংশ হয়ে আছে। এর অত্যাবশ্যক ফ্যাটি অ্যাসিডগুলি এমন একটি পুষ্টিকর এজেন্ট হিসাবে কাজ করে যা আপনার নিস্তেজ ত্বকে জীবন বিস্মিত করার মতো আশ্চর্য কাজ করতে পারে।

গরুর দুধ থেকে তৈরি ঘি বা খাঁটি দেশি ঘি আপনাকে নরম এবং কোমল ত্বক দেওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর বলে অভিহিত করা হয়। ঘি সমস্ত ত্বকের জন্য উপযুক্ত হিসাবে পরিচিত এবং এটিতে ত্বকের কোষগুলিকে হাইড্রেশন করতে সাহায্যকারী গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে।

কোমল এবং চকচকে ত্বকের জন্য ঘি ফেস মাস্ক তৈরির উপায় :

একটি পাত্রে ২ টেবিল চামচ ঘি, ২টেবিল চামচ বেসন বা হলুদ এবং জল মিশান। মিশ্রণটি ভাল করে নাড়ুন।ঘন তবে শুকনো নয় তা নিশ্চিত করুন। যদি মিশ্রণটি খুব পাতলা হয় তবে এতে বেসন বা হলুদ দিয়ে একটু ঘন করে নিন।

পেস্টটি ভালভাবে মিশিয়ে আপনার মুখে লাগান। এটি কমপক্ষে ২০ থেকে ৩০ মিনিটের জন্য লাগিয়ে রাখুন; ঠান্ডা জল দিয়ে এটি ধুয়ে ফেলুন। সেরা ফলাফলের জন্য সপ্তাহে অন্ততঃ তিনবার  করুন।

ঘিয়ের ভিটামিন ‘কে’ ক্যালসিয়ামের সঙ্গে মিলে হাড়ের স্বাস্থ্য ও গঠন বজায় রাখে। স্বাস্থ্যকর ইনসুলিন ও শর্করার মাত্রা বজায় রাখতে কাজে লাগে ভিটামিন ‘কে। ঘিতে যেসব ভিটামিন রয়েছে -এ, ডি, ই এবং কে, যা আমাদের হৃৎপিন্ড, হাড়ের জন্য খুব উপকারী।

এই ঘিয়ের মধ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক লুব্রিকেন্ট যা গিঁটে ব্যথা ও আর্থ্রাইটিসের সমস্যা সমাধানে কাজ করে। তাছাড়া এর মধ্যে রয়েছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড। এটি অস্টিওপরোসিস প্রতিরোধে কাজ করে এবং হাড়কে ভালো রাখে।

চুল ঝলমলে করে এবং চুলকে ময়েশ্চারাইজ করতে সহায়তা করে:

ঘি-তে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানগুলো চুলের স্বাস্থ্য বজায় রাখে ও চুল উজ্জ্বল করে। খালি পেটে ঘি খেলে চুলের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। এটি চুল পড়া প্রতিরোধে সাহায্য করে। ঘি চুল নরম, উজ্জ্বল করতে উপকারী।মাথার ত্বকে ব্যবহার করলে ত্বকের শুস্কতা দূর করে এবং ঘন, ঝলমলে চুলের বিকাশকে উৎসাহ দেয়।

উপকারী কলেস্টেরল:

কোলস্টেরল দু ধরনের- উপকারি ও ক্ষতিকর।ঘিতে রয়েছে উপকারি কোলস্টেরল। ঘিতে রয়েছে কনজুগেটেড লিনোলেক অ্যাসিড। এই অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টের অ্যান্টি-ভাইরাল গুণ রয়েছে।যা ক্ষত সারাতে সাহায্য করে।ডেলিভারির পর নতুন মায়েদের ঘি খাওয়ানো হয় এই কারণেই।

ঘিতে স্বাস্থ্যকর ফ্যাট থাকে:

ঘিতে চর্বিগুলির উচ্চ ঘনত্ব রয়েছে, তবে এটি মনোস্যাচুরেটেড ওমেগা -3 এস এ উচ্চ।  এই ফ্যাটি অ্যাসিড একটি স্বাস্থ্যকর হৃদয় এবং কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেমের জন্য খুবই ভালো। ঘি কিন্তু মিডিয়াম ও শর্ট চেন ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ তাই উপযুক্ত গ্রহণে হার্ট ভালো রাখতে সাহায্য করে।ভারতের একটি গ্রামাঞ্চলে পুরুষদের উপর পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা বেশি পরিমাণে ঘি গ্রাস করেন তাদের করোনারি হার্টের অসুখ এবং সিরাম কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস পায়।

মস্তিষ্কের জন্য ভালো:

আসলে এতে উপস্থিত ওমাগা- ৬ এবং ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড শরীর এবং মস্তিষ্ককে চাঙ্গা রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রসঙ্গত, সম্প্রতি প্রাকাশিত বেশ কিছু গবেষমায় দেখা গেছে এই দুই ধরনের ফ্যাটি অ্যাসিড ডিমেনশিয়া এবং অ্যালঝাইমারসের মতো রোগের প্রকোপ কমাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।নিউট্রিশনিস্টদের মতে নার্ভের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সার্বিকবাবে ব্রেন পাওয়ারের উন্নতিতে ঘি-এর কোনও বিকল্প হয় না বললেই চলে।

দুগ্ধজাত অ্যালার্জিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য ঘি একটি কার্যকর বিকল্প:

যেহেতু ঘি দুধের সলিডগুলি সরিয়ে নিয়ে গঠিত হয়, এতে কেবল দুধের শর্করা (ল্যাকটোজ) এবং প্রোটিন (কেসিন) থাকে এবং এটি দুগ্ধজাত অ্যালার্জিযুক্ত বেশিরভাগ মানুষের জন্য উপযুক্ত একটি খাবার।

ঘি একটি পুষ্টির পাওয়ার হাউস:

ঘিতে প্রচুর পরিমাণে ফ্যাট-দ্রবণীয় ভিটামিন এ, ডি, ই এবং কে রয়েছে। এছাড়াও, ঘি অন্যান্য খাবার থেকে শরীরের চর্বিযুক্ত দ্রবণীয় ভিটামিন এবং খনিজগুলির শোষণে সহায়তা করে।

প্রতিদিন এক গ্লাস গরম দুধের সাথে এক চামচ ঘি নিরাময় করতে পারে কনস্টিপেশানও।উপস্থিত উপকারী ফ্যাটি এসিড গুলি ত্বক কে নরম ও বলিরেখা মুক্ত করে।ঘি কিন্তু anti অক্সিড্যান্ট সমৃদ্ধ তাই ইমিউনিটি রক্ষাতেও এর ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়।আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রে বলা হয় ঘি এর সাথে অশ্বগন্ধা বা ব্রাহ্মীশাক মিশিয়ে খেলে মস্তিষ্কের কার্য ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

ঘিতে ক্যান্সার-বিরোধী সিএলএ রয়েছে:

যে সকল গরু রোদে দাঁড়িয়ে ঘাস খায় অর্থাৎ মাঠে চরে বেরিয়ে ঘাস খায় সেই সকল গরুর দুধ থেকে নেওয়া মাখন থেকে যদি ঘি তৈরি করা হয় তখন এতে কনজুগেটেড লিনোলিক অ্যাসিডের স্টোর থাকে। সিএলএ-তে ক্যান্সারের পাশাপাশি কার্ডিওভাসকুলার রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে দেখা গেছে। কিছু গবেষণায় সিএলএ এবং ওজন হ্রাসের মধ্যেও সংযোগ রয়েছে দেখা গেছে।

সতর্কতাঃ

যা কিছু খাবেন পরিমাণমতো খাবেন। আপনার শরীরের অবস্থা বুঝে খাবেন। অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়। আপনি যদি কোনো জটিল রোগে আক্রান্ত হন বা নিয়মিত কোনো ডাক্তারের তত্বাবধানে থেকে কোনো ওষুধ গ্রহণ করলে খাওয়ার আগে অবশ্যই আপনার ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খাবেন।

সূত্রঃ

ndtv, www.ecpi.edu