কন্যা সন্তান জন্ম দিয়ে আপনার বৌমা অলক্ষ্মী নয়। আপনি অশিক্ষিত, দোষটা আপনার ছেলের।

পুরোনো কিছু ধ্যান-ধারণা, কূসংস্কার সমাজে আজও আগের মতোই বিদ্যমান। কন্যা সন্তান বা মেয়ে মানেই সংসারে বোঝা৷ সংসারের পাপ। কন্যাসন্তান হলে সবার মন খারাপ, মুখ ব্যাজার থাকে।

পুত্রসন্তান ভূমিষ্ট হলে পরিবারে আকাশছোঁয়া আনন্দ৷ ছেলে বংশরক্ষা করবে, টাকা-পয়সা রোজগার করবে, পরিবারে সবার অন্ন জোগাবে আর বৃদ্ধ বয়সে পরিবারের দায়দায়িত্ব সামলাবে৷ এই মধ্যযুগীয় বস্তাপচা মানসিকতা সমাজে আজও বদ্ধমূল৷

বাংলাদেশ ও ভারতে প্রায়ই ঘটছে কন্যাসন্তানের জন্মদানে বধূ নির্যাতন৷ এ নিয়ে আন্দোলন তেমন হয়না, রাজনৈতিক দলগুলি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কুশ্রী মানসিকতা বদলাতে আসেনি এগিয়ে৷ নারীবান্ধব কিছু প্রতিষ্ঠান ও NGO- আসলেও তা দিয়ে প্রত্যাশা পূরণ হবার নয়।

অনেক আগের কথা আলাদা৷ মেয়েদের শিক্ষার হার ছিল নগণ্য৷ কিন্তু এখন? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু পাল্টে গেছে। শিক্ষা-দীক্ষা আর মেধায় মেয়েরা আজ অনেক এগিয়ে গেছে৷ মেধাতালিকায় ১ম হচ্ছে। চাকরিতে বড় বড় পজিশন থেকে রোজগার করছে। ঘরে-বাইরে জীবনের প্রতিটি স্তরে তাঁদের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছে।

এই লিঙ্গ বৈষম্য শুরু হয়ে যায় কন্যাসন্তানের জন্মলগ্ন থেকেই৷ খাওয়া-পরা, পুষ্টি, যত্ন-পরিচর্যা – সবদিক থেকেই কন্যাসন্তান যেন অবহেলার পাত্রী৷ এরই চরম পরিণতি কন্যাভ্রুণ হত্যা অথবা কন্যা ভূমিষ্ট হবার পর তাকে পরিত্যাগ করা৷

আল্ট্রাসাউন্ড করে গর্ভস্থ শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ সরকারিভাবে নিষিদ্ধ হলেও, একটা পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশ ও ভারতে প্রতিবছর হাজার হাজার কন্যাভ্রুণ হত্যা করা হচ্ছে৷ অথচ আমরা নিজেদেরকে সভ্য সমাজের মানুষ হিসাবে দাবি করি।

এখনও প্রত্যন্ত গ্রামে সন্তান ভূমিষ্ট হয় ঘরেই৷ তাই তাঁদের রেকর্ড অজানাই থেকে যায়৷ প্রায়শই ঘটছে কন্যাসন্তানের জন্ম দেওয়ায় বধূ নির্যাতন৷মেয়ে সন্তানের মাকে তালাক দিয়ে দেয়।

প্রতিদিন পত্র-পত্রিকায় ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটু চোখ রাখলেই বিষয়টি সম্পর্কে জানা যায়। আসলে এসব ঘটনা পড়তে পড়তে মানুষের মুখস্থ হয়ে গেছে। শ্বশুর বাড়ির লোকেরা আমেনা বেগমকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছে। কেন? কারণ আল্ট্রাসাউন্ড করে তাঁর স্বামী জানতে পেরেছিলেন আমেনা বেগমের গর্ভে কন্যাসন্তান আছে৷

৩-৪ মাসের হলে গর্ভপাত করানো সহজেই সম্ভব। বাচ্চার বয়স ৬ মাসের বেশি হয়ে গেছে। ব্যবসা করবে বলে ১ লক্ষ টাকা যৌতুক এনে দিতে বলে। সেটাও স্ত্রী আনতে পারেনি।  শেষমেশ স্ত্রীকে  জোর করে তরল বিষ খাইয়ে দেন স্বামী৷ পশুরাও বুঝি লজ্জা পাবে এই আচরণে৷

আরো আছে৷ পর পর তিনবার কন্যা সন্তানের জন্ম দেওয়ায় স্ত্রীকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়, হচ্ছে৷ যেন কন্যাসন্তানের জন্য বৌ একাই দায়ী৷

শহরে ডাস্টবিনে নবজাতকে ময়লার ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয়। বারবার মেয়ে হওয়ায় শেষে নবজাত কন্যাকে কাঁথায় মুড়ে ঝোপের মধ্যে ফেলে আসে হতভাগ্য নবজাতকের পরিবার৷ শিয়াল-কুকুর খাবার আগেই ভাগ্যক্রমে কোনো পথচারী শিশুটিকে উদ্ধার করে৷

কি শিক্ষিত আর অশিক্ষিত। কি ধনী বা কি গরিব, কন্যাভ্রুণ হত্যা সবখানে হচ্ছে। সরকার এ বিষয়ে কিছুটা উদ্যোগ নিলেও, অন্যান্য দলগুলো এ ব্যাপারে অনাগ্রহী৷

পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা শুধু ভারতেই নয়, গোটা দুনিয়াতেই আছে৷ তবে ভারতে এবং বাংলাদেশে  কন্যাসন্তানের প্রতি বৈষম্যের একটা বড় কারণ সম্ভবত যৌতুক বা পণপ্রথা৷ শহরে পণপ্রথার প্রকৃতি কিছুটা বদলালেও সর্বত্র সেটা দেখা যায় না৷ পণপ্রথা বেআইনি হলেও তা তুলে দিতে সরকার গরজ  করে না৷

চরম নির্যাতন বা বধূ হত্যা বা আত্মহত্যা পর্যন্ত না গড়ালে পুলিশ প্রশাসন নীরব দর্শকই থাকে৷ অথচ এতবড় একটা সামাজিক ব্যাধি নিয়ে বড় কোনো আন্দোলন তৈরি হচ্ছে না৷ রাজনৈতিক দলগুলি এই ইস্যু নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না, পাছে ভোটব্যাংকে টান পড়ে৷

কেনো আপনার ছেলে দায়ী?

পুরুষরা তাদের শুক্রাণুতে এক্স(X) এবং ওয়াই (Y)- ক্রোমোজোম বহন করে এবং তার (XY)- উপর নির্ভর করে কোনও শিশুর লিঙ্গ নির্ধারিত হয়। কারণ মায়েদের থাকে দুটোএক্স -(XX) ক্রোমোসোম। একটি এক্স ক্রোমোজোম মায়ের এক্স ক্রোমোসোমের সাথে একত্রিত করে একটি বাচ্চা মেয়ে (এক্সএক্স) তৈরি করে এবং একটি ওয়াই ক্রোমোজোম মায়ের সাথে একত্রিত করে একটি ছেলে (এক্সওয়াই) তৈরি করে।

তাই কন্যাসন্তান জন্মদানের জন্য দায়ী পিতা মানে আপনার ছেলে, মা নয়, মানে আপনার বৌমা নয়।