এক বাবুই পাখির গল্প।
বাবুই তার ছোট্ট ছোট্ট দুটি বাচ্চা নিয়ে তার বাসায় পরম আনন্দে ঘুমুচ্ছে। আর তখনই চড়ুই এসে বাবুই কে ডাক দিল।
বাবুই ও বাবুই।
কে গো (ঘুম থেকে জেগে)।
আমি চড়ুই।
কি হইছে?
আজ তো অনেক বেলা হয়ে গেল, খাবারের জন্য যাবে না।
একটু দাঁড়াও বাপু, বাচ্চাদের আরেকটু ঘুম ধরিয়ে দিয়ে যাই।
কত আর করবে ওদের জন্য। কেবল উড়তে শিখছে, কিন্তু এখনো খাবার জোগাড় করতে পারে না।
কি আর করবো বলো। আমি মা হয়ে তো এই বয়সে আর ওদের জোর করে খাবার জোগাড় করে আনতে বলতে পারিনা। যতটা সম্ভব আমি নিজেই ওদের জন্য যেটুকু পারি সেটুকু করবো। তারপর আরও বড় হলে ওরা নিজের রাস্তা নিজেই ঠিক করে নেবে।
এবার চল তো।
আচ্ছা চল।
বাবুই তার বাচ্চাদের আরও একটু গভীর ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে চড়ুই পাখির সাথে খাবারের খোঁজে জঙ্গলের ভেতর চলে গেল। বাবুই আর চড়ুই খুব ঘনিষ্ঠ দুজন বন্ধু। আর এরা যখন যেখানেই যাক না কেন, দুজন একসাথে যাবে। যাতে করে এক জনের বিপদ হলে আরেক জন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে।
বাবুই পাখির বাচ্চা গুলো খুব শেয়ানা। তারা কেবল উড়তে শিখেছে। কিন্তু ওদের মা সারাদিন খাটাখাটনি করে খাবার জোগাড় করে সে বিষয়ে ওদের কোনো খেয়াল নেই। সারাদিন শুধু টইটই করে ঘুরে বেড়ানো ওদের কাজ।
এদিকে বাবুই আর চড়ুই আজ উড়তে উড়তে অনেক দূরে চলে গেল কিন্তু আজ এখনো কোনো খাবার পেল না। অন্য দিন খুব কাছে গেলেই খাবার পেয়ে যায় কিন্তু আজ তার নাম গন্ধ নেই।
অনেক উড়ে আসার জন্য দুজনেই খুব ক্লান্ত হয়ে গেল। তাই নিচে কোনো এক গাছের ডালে নেমে দুজনেই বিশ্রাম নেওয়ার প্রস্তুত নিল। অতঃপর দুজন নেমে পড়লো। নিচে নেমে দুজনে বিশ্রাম নিয়ে আবার উড়তে শুরু করলো।
এবার তারা একটু দূরে গিয়েই খাবার পেয়ে গেল। দুজনে মুখ ভর্তি খাবার নিয়ে খুশি মনে তাদের বাসার দিকে রওনা হলো। এবার খুব শিঘ্রই তারা বাসায় ফিরে আসলো।
বাবুই ওর বাসায় এসে দেখে তার বাচ্চারা খেলা করছে ঘুম থেকে উঠে। আর তারা বাবুই কে খাবার শুদ্ধ দেখে খুশিতে বাবুই এর চারদিকে ঘুরে ঘুরে উড়তে লাগলো।
তারপর বাবুই ওদের খাবার খাওয়াতে লাগলো।
খাবার খেয়ে দু বাচ্চা বাসার আশেপাশে উড়ে উড়ে খেলতে লাগলো। আর বাবুই আরেক টু বিশ্রামের জন্য বাসার ভেতর ঢুকে গেল। কিছুক্ষন পর বাবুই বাসা থেকে বের হয়ে দেখে তার বাচ্চারা আবার খেলতে খেলতে বাসার নিচেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
বাচ্চাদের ঘুম দেখে বাবুই চড়ুই পাখির বাসায় যায়। চড়ুই পাখির বাসায় গিয়ে বাবুই দেখে,, চড়ুই আর তার ছোট বাচ্চারা তাদের বাসা আরও শক্ত করার জন্য, তিনজনে ভালো করে খড় আর লতাপাতা দিয়ে আরও শক্ত করে বাসা বুনছে।
চড়ুই পাখির দুটি বাচ্চা আর বাবুই পাখিরও দুটি বাচ্চা, দুজনেরই বাচ্চা প্রায় সমান, মাত্র ২ দুদিনের ব্যবধান। আর ওদের বাবারাও দু বন্ধু ছিলো, এক সময় তারা দুজনে খাদ্য আনতে গিয়ে এক শিকারীর হাতে প্রাণ হারায়। তাই এখন ওরাই যায় খাদ্যের সন্ধানে।
চড়ুইয়ের বাচ্চাদের কাজ করতে দেখে, বাবুই ভাবে চড়ুই পাখির বাচ্চাদের মতো যদি তার বাচ্চারাও তার সাথে একটু আকটু কাজ করতো তাহলে নিজে একটু কষ্টের হাত থেকে বেঁচে যেতো।
বাবুই পাখি তখন চড়ুই পাখির হাতে হাতে এটা ওটা এগিয়ে দিয়ে চড়ুই কে সাহায্য করতে লাগলো। কাজ শেষ হলে বাবুই তার বাসায় ফিরে এলো। এসে দেখে তার বাচ্চারা আবার খাবারের জন্য চেচামেচি করতেছে। এখন বাবুই বাধ্য হয়ে আবার চড়ুই পাখির কাছে গেল একটু খাবার আনতে।
চড়ুই শুনছো?
কি গো বাবুই?
একটু খাবার হবে?
কি করবা?
আর বলো না, বাচ্চা গুলো আবার খাবারের জন্য চিল্লাচিল্লি করছে।
দুপুর বেলা না খাওয়ালে আবার এখনই খাওয়াবে?
কি আর করবো বলো? আমার বাচ্চা গুলো তো শুধু খাইখাই করে।
আচ্ছা, একটু দাঁড়াও এনে দিচ্ছি।
তারপর চড়ুই বাবুই কে খাবার দিলে বাবুই খাবার নিয়ে ওর বাসায় চলে যায়,,, তারপর নিজের বাচ্চাদের খাওয়ায়।
এভাবেই চলতে থাকে এই ছোট্ট বাবুই পাখির কষ্টের জীবন। একলা পাখি বাবুই। নিজে একাই কষ্ট করে খাবার সংগ্রহ আর বাসার রক্ষা করে। বাসা ঝড়ে ভেঙে গেলে যত কষ্টই হোক একাই মেরামত করে।
একাই সারাদিন একটু খাবারের খোঁজে ঘুরে বেড়ায়। ডানা গুলো দিয়ে উড়তে উড়তে অনেক ব্যথা হয়ে যায় তবুও সে থামে না। তাকে উড়ে যেতেই হবে। কারণ বাবুই পাখির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে দুটি বাচ্চা মুখ। আর তাদের যে বাবুই কোনো দিনও একটু কষ্ট পেতে দেবে না। নিজের যাই হোক না কেন বাচ্চাদের সে ভালো রাখবেই।
এভাবে শুধু সারাদিন ঘুরে ফিরে চলে যাচ্ছে এই ছোট্ট বাবুই পাখির জীবন।
৫ মাস পর,,,,,,,,,
এখন বাবুই পাখির বাচ্চা গুলো বড় হয়েছে। সবকিছু করতে পারে। কিন্তু ওরা খুব অলস। একটা কাজও করে না। বাবুই পাখিকে আজও খাটুনি করতে হয়। আজও ওদের জন্য খাবার আনতে যেতে হয়।
বাবুই যখন দেখে চড়ুই আর তার বাচ্চারা মিলে খাবার খোঁজতে গেছে তখন বাবুই পাখির দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরে। কারণ তার বাচ্চা গুলো এতো বড় হইছে তবুও তাকে একটুও সাহায্য করে না।
আজও তাকে কেন ওদের জন্য খাবার খোঁজতে যেতে হয়। অথচ ওদের সমবয়সী চড়ুই পাখির বাচ্চা গুলো ওদের মার সাথে খাবার আনতে যায়। বাসা বুনে।
আর ওর বাচ্চারা শুধু শুধু এখনো বাসায় বসে থাকে। আর ঘুরাঘুরি খেলাধূলা করে সময় কাটায় আর বাবুই কে একাই এখন ওদের দুজনের জন্য খাবার সংগ্রহ করতে যেতে হয়।
এখন কখনো কখনো বাবুই তার বাচ্চাদের কে অনেক বকে, এতো বড় হইছে তবুও কেন কোনো কাজ করে না। খাবার আনে না।
আমি আর কতদিন করবো তোদের জন্য, যেদিন থাকবো না সেদিন কি করবি। এভাবে বসে থাকলে কি অন্য কেউ এসে এমনি এমনি খাবার দিয়ে যাবে। যখন মরে যাব তখন বুঝবি মার কাজে সাহায্য না করার ফল।
এই বলে, বাবুই পাখি তার বাচ্চাদের সামনে অনেক কান্না করে কিন্তু সে কান্না তার বাচ্চাদের কানে পৌঁছায় না। তারা কিচ্ছু বলে না, শুধু চেয়ে থাকে মার দিকে।
কয়েক দিন পর,,,,
একদিন বাবুই তার বাসা ছেড়ে অনেক অনেক দূরে চলে এসেছে তার বাচ্চাদের রেখে খাবারের খোঁজে। তারপর যখন খাবার খোঁজতে নিচে নামলো। তখনই শিকারের অপেক্ষায় উত পেতে থাকা এক বনবিড়াল ঝাপিয়ে পড়ে বাবুই পাখির উপর।
বাবুই তখন অপ্রস্তুত ছিলো তাই সে উড়াল দিয়ে পালানোর সময় পায়নি। বিড়ালের হাতে পরে যায় বাবুই। অনেক কষ্ট করেও সে নিজেকে বিড়ালের কাছ থেকে ছাড়াতে পারেনি। কয়েক মিনিটের ভেতর বিড়াল বাবুই কে ছিড়ে খেয়ে ফেলে। বিড়ালের পেটে চলে যায় বাবুই নামের এক নিষ্পাপ পাখি।
আজ সে তার বাচ্চা আর চড়ুই বন্ধু কে রেখে অনেক দূরে চলে যায়।
বাবুই তো আজ একাই বের হয়েছিল তাই তার মরে যাওয়ার খবর হয়তো কেউ জানবে না। কেউ বলতে পারবে না সে কই গেছে। আদৌ বেঁচে আছে কিনা মরে গেছে কে জানে?
বাবুই পাখির বাচ্চা গুলো হয়তো বাবুই পাখির জন্য অধীর অপেক্ষায় পথের দিকে চেয়ে আছে। তাদের মা কখন খাবার নিয়ে আসবে, আর কখন তারা খাবে। কিন্তু তাদের আজকের এই অপেক্ষা বোধ হয় কোনো দিন শেষ হবে না।
কারণ, এখন সারাজীবন অপেক্ষা করলেও বাবুই আর ফিরে আসবে না। ওরা হয়তো জানতেও পারবে না, ওদের মা মারা গেছে। একটা বিড়াল তাকে মেরে ফেলছে।
এখন হয়তো ওরা আর খাবার পাবে না। নিজেদের কেই খাবারের জন্য বের হতে হবে। আর ওরা তো খাবার খোঁজার কৌশল জানে না। ওদের মার কাছ থেকে ওরা শিখে নাই। হয়তো খাবার না আনতে পেরে ওরাও একদিন অনাহারে মারা যাবে।
কিংবা এই অপেক্ষা করতে করতেই ওরা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। কিন্তু আর সারাজীবন ভাবলেও বা কাজ করলেও আর ওদের বাবুই মা আর ওদের কাছে ফিরবে না। কারণ সে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে।