বাজপাখি ও তার বন্ধুরা

এক বনের ধারে ছিল একটি দিঘি। সেই দিঘির মাঝামাঝি একটি দ্বীপ ছিল। সেই দ্বীপে একটি বাজপাখি তার পরিবার নিয়ে বাস করত। দ্বীপটির উত্তর প্রান্তে বাস করত একটি সিংহ। পূর্ব প্রান্তে বাস করত একটি মাছরাঙা পাখি। আর দক্ষিণ প্রান্তে বাস করত একটি কচ্ছপ।

একদিন মা বাজপাখিটি বাবা বাজপাখিকে জিজ্ঞেস করল, এই দ্বীপে কি তোমার অনেক বন্ধু আছে? বাবা পাখি বলল, না, এখানে আমার কোনো বন্ধু নেই। মা পাখি বলল, তোমার অবশ্যই কিছু বন্ধু থাকা উচিত। কারণ আমরা যে কোনো সময় কোনো বিপদে পড়তে পারি।

আর বিপদে তো বন্ধুরাই সাহায্য করে। বাবা পাখি বলল, কাদের সাথে আমি বন্ধুত্ব করতে পারি? মা পাখি বলল, মাছরাঙার সাথে বন্ধুত্ব করতে পারো। সিংহের সাথে বন্ধুত্ব করতে পারো আর পারো কচ্ছপের সাথে। তারা তো এই দ্বীপেই থাকে।

সে সবার কাছে গেল এবং বলল, আমরা তো সবাই এই দ্বীপে থাকি। সে হিসাবে আমরা সবাই প্রতিবেশী। তাই আমাদের মাঝে বন্ধুত্ব থাকা উচিত। কারণ আমরা যে কেউ যে কোনো সময় বিপদে পড়তে পারি। আর বিপদেই বন্ধুর প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।

একদিন পাশের বনে একদল শিকারি এলো। তারা সারাদিন ঘুরে ঘুরে কোনো শিকার পেল না। শিকার করতে এসে খালি হাতে বাড়ি ফিরে যেতে চাইল না তারা। তাই বনের কাছের দ্বীপটিতে গেল, সেখানে কোনো শিকার পাওয়া যায় কি না এই আশায়।

শিকারি দলের একজন বলল, আমরা এই দ্বীপটিতে রাত কাটাব। আর সকালে দেখব এখানে কোনো শিকার পাওয়া যায় কিনা।

যেই কথা সেই কাজ। তারা সেখানে তাঁবু গাঁড়ল। বিছানা পাতল এবং ঘুমানোর জন্য শুয়ে পড়ল। শিকারিদের তাঁবুটি ছিল বাজপাখিরা যে গাছটায় থাকে ঠিক তার নিচেই। দ্বীপটিতে ছিল প্রচুর মশা আর মাছি। তাদের যন্ত্রণায় শিকারিরা কিছুতেই ঘুমাতে পারছিল না। মশামাছি তাড়ানোর জন্য তারা কিছু ডালপালা যোগাড় করে আগুন জ্বালাল।

আগুনের ধোঁয়ায় মশামাছি দূর হলো। কিন্তু সে ধোঁয়া ওপর দিকে উঠে বাচ্চা বাজপাখিদের চোখ জ্বালা করতে লাগল। একটি ছোট্ট বাজপাখি চোখে ধোঁয়া যেতেই চিৎকার করে কেঁদে উঠল। পাখির কান্না শুনে এক শিকারি আরেক শিকারিকে বলল, পাখির কান্না শুনতে পাচ্ছ? নিশ্চয় এই গাছটিতে পাখির বাচ্চা আছে। সকালে আমরা পাখির বাচ্চার রোস্ট দিয়ে নাশতা করব।

মা পাখি বলল, শিকারির দল টের পেয়ে গেছে আমরা এখানে আছি। ওরা আমাদের বাচ্চাদের ধরে নিয়ে রোস্ট বানিয়ে খাবে। তুমি তাড়াতাড়ি তোমার বন্ধুদেরকে জানাও যে আমরা বিপদে পড়েছি। তারা নিশ্চয় আমাদেরকে রক্ষা করবে। সকাল হতেই বাবা বাজপাখি ছুটল তার মাছরাঙা বন্ধুর কাছে।

মাছরাঙা বলল, কী ব্যাপার বন্ধু? এত সকাল সকাল কী খবর নিয়ে এসেছ? বাবা পাখি তার বিপদের কথা বলল মাছরাঙার কাছে। মাছরাঙা বলল, কোনো চিন্তা করো না বন্ধু। তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় যাও। সবাইকে নিশ্চিন্তে থাকতে বলো। আমি এখনই আসছি।

বাবা বাজপাখিটি তার বাসায় ফিরে গেল। আর মাছরাঙাটি কাছের দিঘি থেকে ঠোঁটে করে পানি নিয়ে আগুনের কাছে এলো। মাছরাঙা তার ঠোঁটের সবটুকু পানি আগুনের ওপর ছিটিয়ে দিল। তাতে আগুন নিভে গেল। শিকারিটি তখন আবার আগুন জ্বালাতে শুরু করল।

শিকারি দল যতবার আগুন জ্বালাল ততবারই মাছরাঙা পানি এনে আগুন নিভিয়ে দিতে লাগল। এভাবে অনেকবার আগুন নেভানোর পর মাছরাঙা ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তখন বাবা বাজপাখি বলল, আমি কচ্ছপ বন্ধুকে খবর দিচ্ছি। সে এলেই তুমি বিশ্রাম নিতে পারবে। বাজপাখি উড়ে চলল কচ্ছপের কাছে।

কচ্ছপ বলল, কী খবর বন্ধু? কোনো বিপদে পড়েছ নাকি? বাজপাখি বলল, হ্যাঁ বন্ধু। শিকারির দল আমাদের বাচ্চাদের শিকার করার চেষ্টা করছে।

তারা আমাদের বাসার নিচে আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়া দিচ্ছে। তাতে আমাদের বাচ্চারা কষ্ট পাচ্ছে। মাছরাঙা অনেকক্ষণ ধরে আগুন নেভাতে নেভাতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এখন তুমিই আমাদের ভরসা।

কচ্ছপ বলল, কোনো চিন্তা করো না বন্ধু। আমি আসছি। কচ্ছপ দিঘি থেকে একেক দলা কাদা এনে আগুনের ওপর ছড়িয়ে দিচ্ছিল আর তাতে আগুন নিভে যাচ্ছিল। এক শিকারি বলল, আমরা শুধু শুধুই পাখির বাচ্চা ধরার চেষ্টা করছি। এর চেয়ে সুন্দর নাশতা তো আমাদের সামনেই রয়েছে। চলো আমরা কচ্ছপটাকে ধরি।

আরেক শিকারি বলল, কিন্তু আমাদের সাবধান হতে হবে। নইলে ও আমাদের কামড়ে দিতে পারে। চলো আমরা একটা জাল যোগাড় করি। শিকারির দল জাল যোগাড় করতে করতে কচ্ছপটি দিঘির পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং গভীর পানির নিচে ডুব দিয়ে রইল।

শিকারির দল বসে বসে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। এক শিকারি বলল, চলো, এই ফাঁকে আমরা আবার আগুন জ্বালাই এবং পাখির বাচ্চাগুলোকে ধরি। মাছরাঙা ক্লান্ত হয়ে ফিরে গেছে। কচ্ছপও পালিয়েছে। এখন আমরা নিশ্চিন্তে আগুন জ্বালাতে পারব।

মা পাখি সব শুনে বাবা পাখির কাছে বলল, তাড়াতাড়ি তুমি আমাদের আরেক বন্ধু সিংহের কাছে যাও। তাকে সবকিছু বললে নিশ্চয় আমাদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে।

বাবা পাখি আবার উড়ে চলল সিংহের কাছে। গিয়ে বলল, বন্ধু আমরা ভীষণ বিপদে পড়েছি। একদল শিকারি আমাদের বাচ্চাদের ধরার জন্য আমাদের বাসার নিচে আগুন জ্বালাচ্ছে।

মাছরাঙা বন্ধু আগুন নেভাতে নেভাতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কচ্ছপ বন্ধুকেও তারা ধরার জন্য জাল যোগাড় করে রেখেছে। সে এখন গভীর পানির নিচে পালিয়ে রয়েছে। এখন তুমি যদি আমাদের কোনো উপকার করতে পারো।

সিংহ বলল, হ্যাঁ বন্ধু, বিপদেই তো বন্ধুর পরিচয়। তুমি গিয়ে তোমার বাচ্চাদেরকে সাহস দাও। আমি আসছি এক্ষুনি। এই বলে সিংহ গর্জন করতে করতে শিকারিদের তাঁবুর কাছে আসতে লাগল। গর্জন শুনে শিকারিরা ভাবল, এবার বুঝি সবাই মারা পড়ব। ভয় পেয়ে তারা যে যেমনি পারল পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করতে লাগল।

সিংহ যখন বাজপাখির বাসার কাছে এলো তখন শিকারিরা একজনও আর সেখানে রইল না। মাছরাঙা আর কচ্ছপ তখন আবার ফিরে এলো। বাজপাখি বলল, তোমরা সবাই মিলে আমাদের বাঁচালে। আসলে বিপদেই বন্ধুর প্রয়োজন হয়।