সন্তানকে কিভাবে আদর্শবান বা ভালো মানুষ করে বড় করে তুলবেন?
অনেক বাবা-মা তাদের বাচ্চাদের গ্রেড এবং বহির্মুখী ক্রিয়াকলাপগুলিতে অনেক বেশি মনোনিবেশ করেন যেমন বাচ্চাদের পড়াশোনা অর্থাৎ কিভাবে এ+ পাওয়া যায়, ব্যাচে ভর্তি করানো, একাধিক টিচার-এর কাছে পড়ানো। নিশ্চিত করে, তাদের বাড়ির কাজ করা এবং সময় মতো সকল অনুশীলন বা নাচ, গানের পাঠের দিকে নজর দেওয়া।
তবে সময় এবং প্রচেষ্টা বা খেয়াল যেখানে ওগুলোর মতো গুরুত্বপূর্ণ, সম্ভবত আরও বেশি প্রয়োজনীয়। সন্তানের সাফল্য এবং বিকাশের আরেকটি উপাদানকে লালন করতে আমরা পিতামাতারা ভুলে যাই, সেটি হলো — একজন ভাল মানুষ হওয়া।
আমাদের সমাজে প্রচলিত তাৎক্ষণিক তৃপ্তি, ভোগবাদ এবং স্বার্থপরতার বেড়াজালে আদর্শের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গুরুত্বকে ভুলে যাওয়া সহজ হতে পারে।
যদি আমরা সত্যিকারের সুন্দর মানুষ হিসাবে বাচ্চাদের বড় করতে চাই তবে আমরা আমাদের বাচ্চাদের এমন অভ্যাস এবং আচরণের দিকে পরিচালিত করতে সাহায্য করতে পারি যা কম সুবিধাগ্রস্থ বা যাদের সহায়তার প্রয়োজন তাদের প্রতি দয়া, উদারতা এবং সহানুভূতির মতো ইতিবাচক চরিত্রের বৈশিষ্ট্যকে গঠন করে ও উন্নত করে।
আজকালকার বাবা মায়েদের একমাত্র টেনশন, দুশ্চিন্তার কারণ বা প্রথম অভিযোগ- বাচ্চা অত্যন্ত দুস্টু। কথা শোনে না-কথার বাড়ীর ধার দিয়ে হাঁটে না(গ্রামীণ প্রচলিত) জিদ করে। যেটা চাবে সেটা দিতেই হবে। খারাপ জিনিস দ্রুত শেখে।
কারো কারো বাচ্চা বেড়াতে গেলে বা আত্বীয় স্বজনের বাড়ীতে গেলে এমন কিছু করে বসে যে মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যায়। বাইরের পরিবেশ এমন বাচ্চা একটু বড়ো হলে অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়া বা মাদকাসক্ত হয়ে পড়া নিয়ে আতংকে থাকেন অনেক পিতা মাতাই।
সন্তানকে আদর্শবান করার কিছু উপায়
কখনো কি ভেবেছেন আপনার শিশু লালন-পালন পদ্বতিতে ভুল আছে? কখনো কি ভেবেছেন যে- আজকের অতিরিক্ত আদর বা শাসন শিশুর আগামী ধংস করে দিতে পারে?
আজকাল অনেক বাচ্চারাই অল্প বয়স থেকেই টাকা কিংবা দামী জিনিসের জন্য পিতা মাতাকে চাপ দিয়ে থাকে। মনে রাখবেন, আপনার সন্তান ঠিক সেভাবেই বেড়ে উঠবে যেভাবে আপনি তাকে মানুষ করবেন।
এখানে কিছু উপায় রয়েছে যা পিতামাতারা ভাল চরিত্র তৈরি করতে এবং তাদের সন্তানকে একটি ভাল ব্যক্তি হিসাবে গড়ে উঠতে সহায়তা করতে পারে:
স্বেচ্ছাসেবকমূলক কাজ সন্তানদের শিখিয়ে দিন:
স্বেচ্ছাসেবীর কাজটি আপনার সন্তানের চরিত্রকে রূপ দিতে পারে। ফুটপাথের কোনও বৃদ্ধ অনাহারী, অর্ধহারী প্রতিবেশীকে সাহায্য পৌঁছে দেওয়া। ময়লা ও দূষণ থেকে দেশকে বাঁচাতে গাছ লাগানো, প্লাস্টিকের জিনিসপত্র সঠিক জায়গায় ফেলানো। ডাবের খোলা, প্লাস্টিকের টাযার, ডেঙ্গু মশা জন্মাতে পারে।
বাচ্চারা যখন অন্যকে সহায়তা করে, তারা তাদের চেয়ে কম ভাগ্যবানদের প্রয়োজনগুলি সম্পর্কে চিন্তা করতে শেখে এবং অন্যের জীবনে একটি পার্থক্য তৈরি করার জন্য তারা নিজেরাই গর্বিত বোধ করতে পারে।
স্বল্প পরিমাণে পুরষ্কার সরবরাহ করুন:
বাচ্চাদের নিজের ভালো কাজ করার জন্য বা উৎসাহিত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল প্রতিটি ভাল কাজের জন্য তাদের পুরষ্কার দেওয়া। এইভাবে, আপনার শিশু নিজের জন্য জিনিস পাওয়ার সাথে স্বেচ্ছাসেবীর সাথে সম্পৃক্ত হবে এবং শিখবে যে অন্যকে সহায়তা করা সম্পর্কে ভাল অনুভূতি নিজেই একটি পুরষ্কার হয়ে উঠবে।
এর অর্থ এই নয় যে আপনি মাঝে মাঝে আপনার শিশুটিকে বিশেষ চিকিত্সার জন্য বাইরে নিয়ে যাওয়া বা অন্যকে সাহায্য করার জন্য এবং কঠোর পরিশ্রম করার জন্য এবং কঠোর অধ্যয়নের জন্য তাদের উপহার প্রদান করা উচিত নয়।
বাচ্চারা উৎসাহ পছন্দ করে এবং পিতামাতার অনুমোদনে সাফল্য লাভ করে। মাঝেমধ্যে পুরষ্কার হল দুর্দান্ত কাজের জন্য তাকে দেখানোর এক দুর্দান্ত উপায়।
নিয়মিত “না” বলুন :
সন্তান যা চাইবে, সেটাই দিয়ে দেবেন না। বড়ো হলে তো নাই, ছোটবেলাতেও না। অনেক পিতামাতাই ছোট্ট শিশুরা যেটা চাইছে কান্না থামানোর জন্য সেটাই হাতে দিয়ে দেন।
ফলে মোবাইল ফোন, ট্যাবসহ সকল জিনিস হাতে নেয়া তাদের অভ্যাস হয়ে যায়। আর বাচ্চারা এগুলোর ভালো দিক বাদ দিয়ে বাজে দিকের উপরে বেশি ঝুঁকে পড়ে।
ছোটবেলা থেকে বাচ্চাদের বুঝতে হবে যে চাইলেই সব কিছু পাওয়া যাই না। কেঁদে কোনো লাভ নেই। ফলে বড় হলেও অযৌত্তিক কোনো জিনিস পাবার আশা সন্তানেরা করবে না।
শিষ্টাচার শিক্ষা :
বাচ্চাকে সমস্ত মানবিক আদব কায়দা ছোট বেলা থেকে শেখান। যেমনঃ স্যরি বা থ্যাংক ইউ বলা, অন্যকে সাহায্য করা, কাউকে ব্যাঙ্গ না করা, মিথ্যা না বলা, অন্যের ক্ষতি না করা, গালাগাল না দেওয়া।
দান করতে শেখান :
আপনার সন্তানকে দান করার শিক্ষা দিন। দান করে দাতা কর্ণ বা হাজী মুহাম্মদ মহসিন হতে হবে তা নয়। বাড়ির পাশের মারাত্মক অসুস্থ্য কোনো রোগী, সাহায্য নিতে আসা ক্যান্সার আক্রান্ত কোনো রোগী। এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রম, গরিব অসহায় মানুষের কল্যানে কাজ করা সংগঠন-এমন বিভিন্ন ক্ষেত্রে দান করতে শেখান।
আর্থিকভাবে, শ্রম দিয়ে বা জিনিসপত্র দিয়ে যেভাবেই হোক দান বা সাহায্য করতে শেখান।
ভালো মানুষের সাথে সম্পর্ক:
কথাটা তো আমরা অনেকেই জানি-সৎসঙ্গে স্বর্গবাস। অসৎসঙ্গে সর্বনাশ। খারাপ ছেলেদের সাথে মিশে মাদকাসক্ত হয়ে গেলো। বাজে ম্যাগাজিন, বাজে ছবি দেখে ব্যাভিচার মূলক কিছু করে বসলো। তাই খেয়াল রাখতে হবে, সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কাদের সাথে মিশছে। তা না হলে সন্তান অচিরেই বিপদ ডেকে আনবে।
ছেলেমেয়েরা খারাপ আচরণে জড়িয়ে পড়ার গল্পগুলি প্রায়ই শিরোনাম হয়, সত্য সত্য যে অনেক বাচ্চা নিঃশব্দে তাদের জীবনের সাধারণ পথে ভাল কাজ করে।
সন্তানের প্রতি সহানুভূতি:
নিশ্চিত করুন যে, সন্তান জানে যে, আপনি তাদের প্রতি যত্নশীল। সংবেদনশীল বুদ্ধি এবং সহানুভূতি বা সন্তানের সমস্যায় নিজেকে নিয়োজিত করার এবং তাদের অনুভূতি এবং চিন্তাভাবনা, বিবেচনা করার ক্ষমতা, ভাল ব্যক্তিদের অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য।
অধ্যয়নগুলি দেখিয়েছে যে উচ্চ আবেগযুক্ত কোয়েনটিভেট থাকা – নিজের অনুভূতি এবং অন্যের অনুভূতি বুঝতে সক্ষম হওয়া – যা জীবনের সাফল্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
আপনার সন্তানের সহানুভূতি উৎসাহিত করতে, আপনার শিশুকে তার অনুভূতি সম্পর্কে কথা বলতে উৎসাহিত করুন এবং যখন কোনও বন্ধুর সাথে কোনও বিরোধ দেখা দেয়, তখন তার বন্ধুটি কীভাবে অনুভূত হচ্ছে তা বিবেচনা করুন।
তাদের ভাল আচরণ শিক্ষা দিন:
বড়দের বা শিক্ষকদের সন্মান ও শ্রদ্ধা করবে। ছোটদের স্নেহ করবে ও ভালোবাসবে। লোকদের সাথে বিনীত উপায়ে কথা বলা। “ধন্যবাদ” এবং “দয়া করে” বলার মতো ভাল আচরণের মৌলিক অনুশীলন করে। বন্ধুদের সাথে কোনও খেলা খেলতে গিয়ে সে কি করে।
মনে রাখবেন আপনি এমন একজন ব্যক্তিকে তৈরি করছেন যিনি এই পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিবেন এবং সারা জীবন অন্যদের সাথে যোগাযোগ করবেন। তাই বলা হয় আপনার শিশুটি কতটা ভালভাবে আচরণ করবে তা গঠনে আপনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারেন।
সূত্রঃ
verywellfamily.com