বর্তমান সম্পর্কগুলো কেন দীর্ঘস্থায়ী হয় না?
অনেকেই বলে থাকেন প্রেম করে বিয়ে করলে সে সম্পর্ক নাকি বেশিদিন টিকছে না। তুলনামূলকভাবে পরিবার থেকে দেখাশুনা করে বিয়ে দিলে, সে সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিযোগ একটাই, ও আগের থেকে পাল্টে গেছে, ও আর আগের মতো নেই। আসলে বিষয়টা পুরোপুরি সত্য নয়। প্রেমের বিয়ে সব যে ভেঙ্গে যাচ্ছে তা নয়। অনেক সম্পর্ক টিকে থাকছে। দেখাশোনা করে দেয়া বিয়ের ক্ষেত্রেও প্রচুর সম্পর্ক ভেঙ্গে যাচ্ছে। বিষয়টা একটু বিস্তারিত আলোচনা করলে পরিষ্কার হবে।
একজন মানুষ কি সারাজীবন একরকম থাকে? সে প্রেমের সম্পর্ক হোক বা দেখাশুনা করে বিয়ে, মানুষতো পাল্টাতেই পারে। হ্যাঁ, তবে যেটা মনে হতে পারে, যে একটা মানুষ যখন অপর একজনকে ভালোবাসে এবং বিয়ে করে, তখন তার কাছে প্রচুর চাহিদা থাকে। বিয়ের পর যখন মানুষের আসল ঘরোয়া চেহারাটা বেরিয়ে আসে তখন তা আর মেনে নেয়া যায় না। কিন্তু আমরা এটা ভুলে যাই যে এটাই আসল। এতদিন মানুষটার শুধু বাইরের সামান্য কিছু অভ্যাস আমরা দেখেছি।
সেজেগুঁজে কিছু নামকরা সুন্দর সুন্দর জায়গায় একত্রে বসে হাতে হাত রেখে কথা হয়েছে, গল্প হয়েছে, নামিদামী রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া হয়েছে। তার ভালো-মন্দ অনেক কিছুই অজানা থেকে যায়। এখন সে সবসময় আমার সামনে থাকবে। তাই তার সারাদিনের সব গুণাবলি আমাদের মেনে নিতে হয়। বিরক্তিকর কিছু অভ্যাস থাকলে, সেগুলোও একইভাবে গ্রহণ করা উচিত। কারণ কোনও মানুষের ভালোটা যেমন আমরা গ্রহণ করি, একইভাবে তার খারাপটাও গ্রহণ করা উচিত। তবে খারাপ অভ্যাসগুলোকে যদি পরিবর্তন করে নেয়া যায় নিজেদের ভালোর জন্য, তবে তা দুই জনকেই সহায়তা করে সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার জন্য।
সম্পর্ক মূলত কি?
এটা কি একটি পারিপার্শ্বিক আকর্ষণ, নাকি পিতা-মাতা থেকে চলে আসা জেনেটিক একটি প্রতিফলন। তাই যদি হতো তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি মানুষকে একটি সম্পর্ক কিভাবে এক নতুন বাঁধনে বেঁধে ফেলতে পারে। তাহলে কি আমরা বলতে পারি না সম্পর্ক মূলত একটি পারস্পরিক চর্চা যাকে পরিচর্যার মাধ্যমে আমরা একটি নতুন রূপ দিয়ে থাকি। পূর্বেই বলেছি সম্পর্কের কোন শ্রেনীবিভেদ নেই কিন্তু সম্পর্কের বিভিন্ন নামকরণ হয়। এই সম্পর্কেই আমরা কখনো হয়ে উঠি বন্ধু, স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা, ভাই-বোন বা বিভিন্ন আত্মীয়। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে সম্পর্কগুলোও হয়ে ওঠে ভিন্ন। কখনো কাছের মানুষ দূরে চলে যায় আবার কখনও সম্পূর্ণ অচেনা মানুষ হয়ে ওঠে কাছের।
সম্পর্ক মূলত কিসের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে?
একটি সম্পর্ক মূলত কতগুলো উপাদানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। কিংবা বলা যায় যে একটি সম্পর্কের কাঠামো মূলত কতগুলো উপাদানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। উপাদানগুলো নিম্নরূপঃ
সততা:
সততা একটি মানবিক গুনাবলি। এটি একজন মানুষকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে। সততা একটি অত্যন্ত সুন্দর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। যা একটি মানুষকে অন্যদের কাছে সম্মানিত করে তোলে।
ওয়াদা বা কথা দিয়ে কথা রাখার প্রবণতাঃ
ওয়াদা একটি কঠিন শব্দ যার গুরুত্ব অনেক এই মানব জীবনে। যে লোক কথা দিয়ে কথা রাখে না সে কখনো নিজেকে একজন ভাল মানুষ বলে দাবী করতে পারে না। যেকোনো ধরনের সম্পর্ক ওয়াদার মাধ্যমে গড়ে ওঠে।
বিশ্বস্ততাঃ
যেকোনো সম্পর্কের মাঝে বিশ্বস্ততা থাকা জরুরী। অন্যথায় কোন সম্পর্কই টিকে থাকে না। বিশ্বস্ততা অনেকটা দায়বদ্ধতার সাথেও সম্পর্কিত। তাই বর্তমান সমাজে এই বিশ্বস্ততায় খুব সহজেই চির ধরতে দেখা যায়।
বন্ধুত্ব:
বন্ধুত্বের মত মিষ্টি সম্পর্ক বোধহয় আর কোথাও নেই। বন্ধুত্ব এমন একটি বাঁধন যা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির বা আচরণের মানুষের সাথে গড়ে উঠতে পারে নিমিষেই। বন্ধুত্ব খুব সহজেই দুটি মানুষের মাঝে প্রাণের সখ্যতা গড়ে তোলে এবং তা আলোয় আলোয় ভরিয়ে দেয়।
দায়িত্ব নেয়ার ক্ষমতাঃ
দায়িত্ব যা কিনা একটি ভারি শব্দ। প্রতিটি মানুষই এর ভার বহন করতে কিছুটা কুণ্ঠিত হয়ে থাকে। কিন্তু যেকোনো সম্পর্ক গড়তে গেলেই এই শব্দটি চলে আসে। যেকোনো সম্পর্কের ভিত্তি যেন এই শব্দটির সাথে জড়িত। তাই যে মানুষের এই দায়িত্ব নেয়ার ক্ষমতা বেশি থাকে সে খুব সহজেই মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে থাকে।
বোঝার ক্ষমতাঃ
একটি সুন্দর সম্পর্ক অনেকটা নির্ভর করে একে অপরের বোঝার ক্ষমতার উপর। যখন একজন অন্যজনের প্রয়োজন সুবিধা- অসুবিধা, রাগ-অনুরাগ বিভিন্ন অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করে এবং কিছুটা বুঝতে পারে তখনই একটি সুন্দর সম্পর্কের সৃষ্টি হয়।
স্বচ্ছতাঃ
মনের দুয়ার যার স্বচ্ছ কাঁচের মত তার দৃষ্টি হয় সুন্দর ও মলিন। আর এমন একটি বৈশিষ্ট্য যার মধ্যে থাকে সে হয়ে যায় অনন্য।
ভালোবাসাঃ
ভালোবাসা শব্দটি একটি অনুভূতির সাথে জড়িত। পৃথিবীতে মনে হয় কেবল মানুষই আছে যেকিনা ভালোবাসার অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করতে জানে সুন্দর সুগভীর শব্দ চয়নে।
এ সকল উপাদানের মিশ্রণে একটি সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারপরেও কিছু থেকে যায় যা কিনা মানুষ তার ব্যক্তিগত দক্ষতা বা গুণাবলীর দ্বারা অতিক্রম করে যায়।
বাড়ছে ফেসবুক ইউটিউবসহ অনলাইনে থাকার প্রবণতা:
ফেসবুক পোস্ট, ক্যারিয়ার কিংবা ভালোবাসার মানুষ, সবক্ষেত্রেই আমরা সাময়িক আত্নতৃপ্তি লাভ করতে চাই। অল্প পরিসরের জানা-শোনা থেকেই আমরা একটা সম্পর্কের পরিপক্কতা কামনা করি। কিন্তু পরস্পর অনুভূতিগুলো অনেক সময় ধরে তৈরী হতে হতে এই পরিপক্কতা আসে।
আমরা বর্তমানে একজনের সাথে পুরো একটা দিন না কাটিয়ে একশ জনের সাথে এক ঘন্টা করে সময় ব্যয় করি। আমরা বিভিন্ন “অপশন” রাখতে বেশি পছন্দ করি।
আমরা মানুষকে ভালোভাবে জানার চেয়ে কেবল নামমাত্র সম্পর্ক রাখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি। আমরা লোভীও বটে। কারণ আমরা সবকিছু পেতে চাই। নামমাত্র ভালোলাগা থেকে আমরা একটা সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছি। তারপর ভালো কাউকে পেলে বর্তমান সম্পর্কে পিছপা হয়ে নতুন দিকে ঝুঁকছি। আমরা একজন মানুষের মধ্যে সবকিছু খুঁজে নিতে পারছি না। আমরা তাকে “পারফেক্ট” হিসেবে পেতে চাই। কিন্তু তাকে কিংবা অন্য কাউকে “পারফেক্ট” হবার জন্যে পর্যাপ্ত সুযোগ দেই না।
হিংসা ও স্বার্থপরতার এই দুনিয়ায় আসলেই ভালোবাসার বড়োই অভাব। মানুষ আর মানুষের থাকছে না। মানুষ আর মানুষকে নিয়ে ভাবছে না। নিষ্ঠুর এই পৃথিবীতে আমরা যার যার স্বার্থ নিয়ে ব্যাস্ত। স্বার্থ উদ্ধার হলে দুঃখ দিয়ে কেটে পড়ি। সবাই মিষ্টি কথা বলে মন ভোলাতে চাই। কিন্তু আমরা যদি একটু উদার মন নিয়ে, একটু ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে আসি তাহলে অনেক ভালো কাজ করা সম্ভব। সমাজটাকে উন্নত করা সম্ভব।
ভালোবাসা কি?
ভালোবাসা হলো অনুভূতি, আচরণ এবং বিশ্বাসের একটি দৃঢ মিশ্রণ। অন্য ব্যক্তির প্রতি স্নেহ, প্রতিরক্ষামূলকতা, উষ্ণতা এবং শ্রদ্ধার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। ভালবাসা মানবেতর প্রাণীদের ক্ষেত্রে, নীতিতে এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কোনও ব্যক্তি বলতে পারেন যে সে তার কুকুরকে ভালবাসে, স্বাধীনতা পছন্দ করে বা ঈশ্বরকে ভালবাসেন।
ভালোবাসা মানুষের অনুভূতি প্রকাশের সর্বোচ্ছ স্তরের নাম। এটি আমাদের দৈনন্দিন সম্পর্কে মিশে সেগুলোকে আরো শুদ্ধ করে তোলে। পরিবার থেকে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে এর পরিধি বাড়তে থাকে। কিন্তু বর্তমান আধুনিক সময়ে এসে ভালোবাসা সমৃদ্ধ সম্পর্ক চারপাশে দিন দিন কমে যাচ্ছে। রিলেশনশিপ দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না এখন আর। সম্পর্কের পৃথিবীটা দিন দিন কেমন যেনো ঘরের ভিতর বন্দি হয়ে যাচ্ছে। কারণ আধুনিকতার মোড়কে আমাদের চিন্তাভাবনার বিশাল পরিবর্তন ঘটেছে। মায়া, মমতা, কর্তব্যবোধ কোথায় যেনো হারিয়ে যাচ্ছে। এই পরিবর্তনের কারণে সম্পর্কের স্থায়িত্বও কমে গেছে।
বর্তমান সম্পর্কগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয় না কেন?
ছাড় দিতে প্রস্তুত নই
বস্তুতঃ আমরা অনেক কিছুতে প্রস্তুত নই। আমরা কোনো ছাড় দিতে প্রস্তুত নই। কোনো আপস করতে প্রস্তুত নই। অন্যের আবেগ বা মতামতকে মূল্য না দিয়ে নিজের ভুল ধারণাকে প্রাধান্য দেয়া। শর্ত ছাড়া ভালোবাসার জন্য প্রস্তুত নই। একটা সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখতে হলে আমাদের যে যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে তা মানতে আমরা রাজী নই।
সহজে পেতে চাই আবার সহজে ছেড়ে দিতে চাই
আমরা সবকিছুকে সহজে পেতে চাই। আবার সবকিছুকে সহজে ছেড়ে দিতে চাই। এগুলোর ফলে কোনো ছোটো বাঁধা আমাদের সামনে এলে সবকিছু শেষ হয়ে যায়। যার কারণে ভালোবাসা পরিণত হওয়ার আগেই আমরা সম্পর্ক থেকে সরে আসি।
ভালোবাসা খুঁজি না
আমরা এখন ভালোবাসা খুঁজি না, শুধু একটা ঘোরের মধ্যে থেকে নিজেদের রোমাঞ্চিত করতে চাই। আমরা সপ্তাহান্তে সিনেমা দেখে কিংবা পার্টিতে উপস্থিত হবার জন্য একজনকে চাই। কিন্তু যে আমাদের গভীর নীরবতার কারণও বুঝবে এমন একজনকে চাই না। সুখে দুঃখে, বিপদে আপদে সমব্যাথী হবে। আমরা একসাথে সময় কাটাতে আগ্রহী কিন্তু স্মৃতি গর্তে আগ্রহী না।
সঙ্গী সারাজীবনের জন্য চাই না
আমরা একঘেয়েমীর মধ্যে থাকতে চাই না। সারাজীবনের জন্য একজন সঙ্গীকে নির্বাচন করি না। কেবল সাময়িক সময়ে নিজেকে প্রাণবন্ত রাখতে সঙ্গী নির্বাচন করি। যখন আমাদের এই ঘোর কেটে যাই তখন একে অন্যের উপর আগ্রহ হারাতে থাকি। আমরা রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে অন্ধবিশ্বাস রাখি বলে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সৌন্দর্যকে বিশ্বাস করতে চাই না।
পর্যাপ্ত সময় ও ধৈর্য থাকে না
আমরা ভালোবার জন্য অন্যের প্রতি যে স্নেহ, শ্রদ্ধা, প্রতিরক্ষামূলক আচরণ, অনুভূতি, বিশ্বাস,আবেগ এগুলোকে পাত্তা না দিয়ে নগর জীবনের নানা বিষয়ে নিত্য বিভোর থাকি। একটি সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের পর্যাপ্ত সময় ও ধৈর্য থাকে না। বস্তুগত সময়গুলোতে আমাদের ব্যাস্ত সময় কাটে। তাই ভালোবাসার মতো অবস্তুগত সম্পর্ককে লালন করতে পারি না। বর্তমানে সম্পর্ক কেবল একটি স্বছন্দবোধের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।