ঠকেছি তো কি হয়েছে, মানুষ চিনতে শিখে গেছি।
মানুষ মানুষকে প্রতারিত করছে। এটা এখন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। প্রতিদিনের প্রতারণার পরিসংখ্যান যদি আপনার সামনে উপস্থাপন করা হয় তাহলে আপনার চোখ আটকে উঠবে। প্রতারণা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। খবরের কাগজ কিংবা গণমাধ্যমে প্রতিদিন সাক্ষ্য হিসাবে এর অনেকটাই আপনার সামনে হাজির করছে।
সমাজে আমরা মানুষ একসাথে বসবাস করি। পরিবার, আত্বিয়স্বজন ছাড়াও অসংখ্য মানুষের সাথে একসাথে চলাফেরা ও কাজকর্মের ফলে বিভিন্ন সম্পর্ক তৈরি হয়। সমাজে মানুষের সাথে মানুষের হাজারো বিষয় নিয়ে প্রতিদিন কতনা সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে সব থেকে বড় একটা নিয়ামক বা প্রভাবক এই সকল সম্পর্ক তৈরির পেছনে।
মানুষের মন এখনো পচে যায়নি। বেশিরভাগ মানুষ ভালো মনের অধিকারী। সহজ, সরল মনে মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করে। কিন্তু প্রতারণার ফলে মানুষের ওপর মানুষের বিশ্বাস নষ্ট হয়, মনটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। যার ফল বা ক্ষতিকর প্রভাব পরোক্ষভাবে সমাজের ওপর এসে পড়ে।প্রতারিত মানুষটা সহজে আর অন্য মানুষকে বিশ্বাস করতে পারে না।
সমাজে ভাঙ্গন শুরু হয়। সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ মানুষের সম্পর্ক নষ্ট করে বলে প্রতারণাকে অনেকে সামাজিক ভাইরাস বলে আখ্যায়িত করেছেন।
বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৪১৫ ধারায় প্রতারণার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া আছে। আসলে প্রতারণার ক্ষেত্র এতো বিশাল হয়ে গেছে বা প্রযুক্তির কল্যাণে নতুন নতুন বিষয়ে এতো অভিনব উপায়ে প্রতারক মানুষকে প্রতারিত করছে তাতে করে প্রতারণার সংগা হয়তো এমেন্ডমেন্ট করে নতুন করে দাঁড় করাতে হবে।
বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৪২০ ধারা অনুযায়ী এই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছরের কারাদণ্ড এবং সঙ্গে অর্থদণ্ডও হতে পারে। আবার যারা এর সঙ্গে জড়িত থাকে কিংবা সহায়তা করে, তারাও দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারা অনুযায়ী সমান অপরাধী এবং সমান দণ্ড পাবে। বর্তমানে প্রতারণার ক্ষেত্র এতটাই ব্যাপক যে, উক্ত আইনগুলো অপরাধের শাস্তি হিসেবে যথেষ্ট নয়। আবার প্রতারণার ধরনভেদে আলাদা আইন ও মামলা-মোকদ্দমা হয়। যেমন: চেক জালিয়াতি, দলিল জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ ইত্যাদি।
মানুষ জীবনে কোনো না কোনো সময়ে ছোটখাটো হলেও বিভিন্নভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। বর্তমান সময়ের ইয়ং জেনারেশন অর্থাৎ তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীর প্রেম-ভালোবাসাজনিত প্রতারণা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। কিছু কিছু প্রতারণায় মানুষ আইনি প্রতিকার আশা করে না বা চায় না, বিষয়টি উড়িয়ে দেয়। আবার সমাজে ছোট–বড় অনেক ধরনের প্রতারণা হয়ে থাকে তাতে বিভিন্ন সময় প্রতারক চক্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়, বিচারের মুখোমুখি হয়। শাস্তিও হয়। কিন্তু এটা কমছে না। নতুন কায়দা-কৌশলে প্রতারণা হয়েই চলেছে।
এটা কি বিচার বা দন্ড না হওয়ার বা কম হওয়ার কারণে? আসামিরা আইনের ফাক-ফোকর দিয়ে বেরিয়ে যান বা জামিন পেয়ে যান এই কারণে বা অনেক সময় আইনের অপর্যাপ্ততা ও যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া যায় না। না যতদিন মানুষ হিসাবে আমাদের মোরালিটি উন্নত না হয়?
অনলাইন টাকা আদান-প্রদানের একটা মাধ্যম হলো বিকাশ।প্রতারকেরা বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে বিকাশ app-ব্যবহারকারীদের সর্বস্বান্ত করছেন। মিথ্যে বিপদের কথা বা পুরস্কারের কথা বলে সহজ সরল মানুষের সিম্প্যাথি আদায় করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। কিছুদিন আগে কয়েকজন বিদেশি শিক্ষার্থী গ্রেপ্তার হন, যাঁরা বাংলাদেশি এক নারীকে সঙ্গে নিয়ে প্রতারণা করে আসছিলেন। তাঁরা ফেসবুক ব্যবহার করে বিভিন্ন উপহারসামগ্রী দেওয়ার নামে মানুষের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতেন।
এতো বড় করোনা মহামারী। এটা নিয়েও প্রতারণা। করোনা শনাক্তের পরীক্ষায় কিছু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ করোনা পরীক্ষা ছাড়াই ফলাফল দিয়েছে। এটা ছিল বড় প্রতারণা। আবার এমনও প্রতারক আছে, যারা ভিন্ন উপায়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতারণা করে থাকে।
ঠকেছি তো বেশ করেছি, মানুষ চিনতে শিখে গেছি। আসলে ঠকে যাওয়া বা প্রতারিত হওয়ার ফলে মানুষ আগের থেকে অনেক সচেতন হয়ে যায়। আমি প্রতারিত হলাম মানে অনেক টাকা আমার কাছ থেকে প্রতারক আত্নসাৎ করলো। এটা অনেক মানুষকে পরশ-পাথর করে দেয়। মানুষ সচেতন হতে শেখে। প্রতারণা থেকে বাঁচতে হলে সচেতনতার বিকল্প নেই।
প্রতারিত হলে থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে বা আদালতের শরণাপন্ন হতে দেরি করবেন না। কোনো ব্যবসা কিংবা লেনদেনে গেলে আইনসম্মত উপায়ে অর্থাৎ আইনজীবীর সাথে পরামর্শক্রমে চুক্তি করে নিতে হবে। কারণ, প্রতারকদের প্রধান লক্ষ্য থাকে অর্থসম্পদ আত্মসাৎ করা। কোনো বিষয়ে লিখিত প্রমাণ ও সাক্ষী থাকলে খুব সহজে আদালতে প্রমাণ করা যায়।
মানুষে মানুষে সম্পর্ক তৈরি হয়। আবার ভুল বোঝাবুঝি বলেন, পাল্লাপাল্লি, হিংসা, ইয়ারকি, জাতিভেদ ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে সম্পর্ক ভেঙে যায়। সম্পর্কের টানাপোড়েন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের চিরাচরিত অংশ। সম্পর্কের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক আমাদের জীবনের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। সেই প্রেমের সম্পর্কেও ব্রেকআপ, কখনো কখনো দেখা দেয় বিচ্ছেদ। প্রিয় মানুষের সাথে কথা কাটাকাটি, মনোমালিন্য। মনে কষ্ট, আঘাত। হৃদয় ভেঙে খান খান হয়ে যাই। আর যদি সেই প্রিয় মানুষ প্রতারক রূপে আবির্ভূত হয়, তবে ভেঙে যায় মন, হারিয়ে যায় বিশ্বাস।
এমন কঠিন আঘাতের পর কেমন করে নিজেকে সামলাবেন তার কিছু টিপস:
সময়ের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিন:
জীবন বহতা নদীর মতো। সময় যেহেতু প্রবাহমান তাই সময়ের ছুটে চলা যেকোনো ক্ষতকে সারিয়ে তোলে। তাই নিজেকে ছেড়ে দেয়া উচিত সময়ের হাতে। প্রতারিত হবার ব্যথা ধীরে ধীরে সময়ের সাথে চলে যাবে। যদিও মানুষ ভুলতে পারে না তার সব থেকে কাছের মানুষের প্রতারণা। তবুও জীবন কখনো থেমে থাকে না, চলতে থাকে এর নিজস্ব প্রবহমানতায়। একা না থেকে বন্ধু বান্ধবদের সাথে সময় কাটান। চেষ্টা করুন ব্যাস্ত থাকার। আর অপেক্ষা করুন কষ্টের ক্ষতে সময়ের শিকল পরার।
মন খুলে কথা বলুন:
কষ্টকে মনের ভিতর চেপে রাখবেন না। কষ্টকে চেপে রাখলে ছাই চাপা আগুনের মতো বাড়তেই থাকবে। তাই উচিত নিজ পরিবার ও আপনজনের সাথে নিজের জীবনের সবথেকে কষ্টের অংশ ভাগাভাগি করে নেয়া। নিজের কাজের জগতে ডুবে যান। কলিগস ও বন্ধুবান্ধবদের সাথে বিষয়টা শেয়ার করুন। গান শুনুন। টিভি দেখুন। ভালো ভালো বই পড়ুন বা মোটিভেশনাল ভিডিও দেখুন।
এভাবেই সম্ভব নিজেকে প্রতারনার জ্বালা থেকে রক্ষা করা। আমরা যখন নিজের দুঃখ কারো সাথে ভাগ করে নেই তখন কষ্ট অনেকখানি লাঘব হয়ে যায়। তাই নিজের জীবনের এত বড় আঘাতকে না লুকিয়ে মন খুলে শেয়ার করুন কাছের কোন মানুষের সাথে। এছাড়া আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা বিভিন্ন আইনি সহায়তা কেন্দ্র তো রয়েছে।
নিজেকে ধোঁকা দেবেন না:
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত আমাদের দেশেও আত্নহত্যা বা নিজেকে শেষ করে দেয়ার প্রবণতা বেড়ে চলেছে। দোষ তো সে করেছে। আমি কেন নিজেকে গুটিয়ে নেবো বা শেষ করে দিবো। নিজের কাছে সত্যিটা স্বীকার করা সবথেকে জরুরী। জীবনের সার্থকতা সাহসী চিত্তে টিকে থাকাতে। দুর্বল চিত্তে নিজেকে শেষ করা আর নয়। তাই নিজেকে ধোঁকা না দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াই জীবনের মূলমন্ত্র হএয়া উচিত।
নিজেকে বিচ্ছিন্ন করবেন না:
নিজেকে ঘরবন্দি করবেন না। সম্পর্কে প্রতারণার শিকার হলে মানুষ বাইরের পৃথিবীর থেকে নিজেকে বিছিন্ন করে ফেলে এবং বন্দি করে রাখে নিজেকে চারদেয়ালের মাঝে। কিন্তু এভাবে নিজেকে তিলে তিলে শেষ করে ফেলার থেকে বুঝতে হবে কারো চলে যাওয়া মানে জীবনের সব চাওয়া-পাওয়া শেষ হয়ে যাওয়া না। নিজেকে সবকিছু থেকে দূরে রাখলেই কিন্তু কষ্ট, ব্যথা, যন্ত্রণা নিঃশেষ হয়ে যাবে না। নিজেকে শক্ত করুন।
অবস্থার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিন:
When you are in the Rome, do as the roman’s do. এই উক্তিটির মতোই। বর্তমান অবস্থার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে।
চরম সত্যিকে মেনে নেয়া অর্থাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা মেনে নেওয়া অনেক সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে।প্রেমের সম্পর্কে প্রতারণা অর্থাৎ কাছের মানুষ ধোকা দিলে সেটা মেনে নেয়া অনেকের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই প্রতারণার শিকার হলে মানুষ বেশিরভাগ সময় বেরিয়ে আসতে পারে না মনঃকষ্ট থেকে এবং হারিয়ে যায় অন্ধকারে। নিজেকে আলাদা করে ফেলে সব কিছু থেকে, চলে যেতে যায় সবকিছুর আড়ালে।
কিন্তু যে আপনাকে ধোঁকা দিয়েছে তার জন্য জীবনটাকে নষ্ট করবেন না। সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়া মানে জীবনের ইতি নয়। অবস্থাকে স্বীকার করার মধ্যে দিয়ে সমস্যার যথাযথ সমাধান করা সম্ভব। পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে গেলে কখনো নিজের মনঃকষ্টের হাত থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব না। অবস্থাকে মেনে নিলেই প্রতারনার কষ্ট অনেকটা কমানো সম্ভব। নিজেকে বর্তমান অবস্থার সাথে মানিয়ে নেয়ার মধ্যে দিয়েই উদ্ভূত বিপত্তিকে পার করার রাস্তা সহজে খুজে পাওয়া যায়।
আনন্দের উৎস খুঁজুন:
নিজেকে আনন্দে রাখার সবচেয়ে সহজ উপায় নিজেকে ব্যস্ত রাখা। নতুন কিছু করুন। ভ্রমণ করতে বেরিয়ে পড়ুন। কিম্বা শিখুন পেইন্টিং বা নতুন কোন শখের কাজ। আনন্দময় জিনিস শেখার মধ্যে দিয়ে কষ্ট আর ব্যথা ভুলে গিয়ে জীবনের স্বাদ আবারো অনুভব করতে শুরু করুন।
ক্ষমা করুন:
ক্ষমা-শব্দটি ছোট্ট হলেও এই দুই অক্ষরের শব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে জীবনের সার। প্রতিশোধ না নিয়ে বা আপনার প্রতারক সঙ্গির স্মৃতিচারন না করে, স্রেফ ক্ষমা করে দিন। কঠিন হলেও একবার যদি মন থেকে ক্ষমা করা যায় তবে দেখবেন আপনার কষ্টের ভার অনেকটাই লাঘব হয়ে গেছে।