অতিরিক্ত মাংস খেলে কি কি ক্ষতি হয়?
প্রত্যেক ব্যক্তির খাদ্যতালিকা গুলির চাহিদা আলাদা, তবে অতিরিক্ত মাংস খেলে যে সমস্ত ক্ষতি একজন মানুষের শরীরকে বহন করতে হয় তা জানলে সে অবশ্যই মাংস খাওয়া কমিয়ে দেবেন। মাংস বেশি খেলে কোন কোন রোগগুলো সামনে এসে হাজির হয়, তা জানলে আপনারা সবাই হয়তো অবাক হবেন।
আমরা সাধারনত মাংস পেলে লোভ সামলাতে পারি না। কিন্তু আমরা তেমন ভাবে জানি না যে, মাংস অতিরিক্ত খেলে কি সমস্যা হয়। মাংস খাওয়া যেমন স্বাস্থ্যর জন্য উপকারী তেমন অতিরিক্ত মাংস খাওয়া স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। চলুন জেনে নেয়া যাক, অতিরিক্ত মাংস খেলে কি কি হতে পারে।
লাল মাংস বা রেড মিট কাকে বলে?
লাল মাংস বলতে গরুর মাংস, শুকরের মাংস, মেষশাবক, খাসি বা ভেড়া বা মাটন, ঘোড়া, veal বা বাছুর এবং ছাগল সহ সমস্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীর পেশী-সম্বলিত মাংসকে বোঝায়। এগুলিতে চর্বির পরিমান বেশি থাকে।
মুরগির মাংস, টার্কির মাংস হোয়াইট মিট হিসাবে পরিচিত। এগুলিতে চর্বির পরিমান কম থাকে।
সুষম ডায়েটে প্রোটিনের জন্য সবসময় মাংসের উপর নির্ভর করতে হবে এমন চিন্তা বাদ দিন। পর্যাপ্ত পরিমানে প্রোটিন আমরা শিম এবং ডাল জাতীয় খাবার থেকে অনায়াসে সংগ্রহ করতে পারি।
গবেষণাকৃত ফলাফল:
লাল মাংস এবং মৃত্যুর সাথে সংযুক্ত একটি সমীক্ষা মিডিয়াকে একাধিক উপায়ে আলোকিত করেছিল। শত শত মিডিয়া আউটলেট এই গবেষণা সম্পর্কে রিপোর্ট বহন করে।
অতিরিক্ত মাংস খেলে কি কি সমস্যা হয়?
অতিরিক্ত মাংস খেলে কি কি স্বাস্থ্য সমস্যা হয় তা আলোচনা করা হলো –
রেড মিট এবং হার্টের রোগ:
নিয়মিত অতিরিক্ত মাংস খেলে প্রথম ফলাফল হিসাবে আপনারা যেটা পাবেন সেটা হলো হার্টের রোগ। মুলত এই সমস্যাটি ৩৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সের মানুষের বেশি হয়ে থাকে।
মাংস এবং স্যাচুরেটেড ফ্যাট:
লাল মাংসে (গরু, খাসি, ভেড়া, শুকর) ফ্যাট বেশি থাকে, বিশেষত স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে। প্রচুর স্যাচুরেটেড ফ্যাট খেলে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায় এবং রক্তে কোলেস্টেরল বেশি থাকা মানে হার্টের রোগের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া। মাংস শরীরে রক্তচাপ বৃদ্ধি করে ফলে ষ্ট্রোক হওয়ারও ঝুঁকি বেড়ে যায়।
অনিয়ন্ত্রত কোলেস্টেরলের করণে হার্টের রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা পত্র অনুসারে প্রতিদিন ৭৫ গ্রাম বা তার বেশি পরিমাণ রেড মিট খেলে হার্ট ফেল হওয়ার আশঙ্কা প্রায় ১.২৮ গুণ বৃদ্ধি পায়।
কত পরিমাণ মাংস খেলে এই সব রোগ হওয়ার আশঙ্কা একেবারেই থাকবে না? প্রতিদিন রেড মিট খাওয়ার পরিমাণ ৫০-৭০ গ্রামের নিচে রাখুন, অর্থাৎ সপ্তাহে ৩০০-৫০০ গ্রামের বেশি একেবারেই নয়। এই পরিমাণ মাংস খেলে দেখবেন কোনও রোগই আপনাকে ছুঁতে পারবে না। উল্টে আমাদের শরীরে পুষ্টির ঘাটতি দূর হবে।
রেড মিট এবং ক্যান্সার:
যদি আমরা প্রচুর লাল এবং প্রক্রিয়াজাত মাংস খাই তাহলে আমাদের অন্ত্রের ক্যান্সারের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
২০১৫ সালে ওয়াল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। তাতে বলা হয়েছিল বেশি মাত্রায় রেড মিট খেলে শরীরে “কার্সিনোজেনিক” এলিমেন্টের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ফলে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে।
বিশেষত কলোরেকটাল ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই বলে ভাববেন না সপ্তাহে ১-২ বার মাংস খেলেই এমন অশঙ্কা বৃদ্ধি পাবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুসারে প্রতিদিন ৫০ গ্রাম করে প্রসেসড রেড মিট খেলে তবেই কলোরেকটাল ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়।
শুধু তাই নয়, এই পরিমাণ রেড মিট যদি প্রতিদিন ফ্রাই করে খাওয়া হয়, তাহলে শুধু কলোরেকটাল নয়, সেই সঙ্গে প্যানক্রিয়াটিক এবং প্রস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও বৃদ্ধি পায়।
অনেক গরু-ছাগলের মাংসে ক্যন্সারের জীবানু পাওয়া যায় আর মাংস পরিমান মত উত্তপ্ত করে রান্না না করার কারনে ক্যন্সারের জীবানু মানুষের শরীরে প্রবেশ করে।
মাংস এবং কিডনি ফেলিওর:
লাল মাংস বেশি খেলে রক্তে ক্ষতিকর টক্সিনের মাত্রা বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনাও থাকে। আর এই কারণেই কিডনি খারাপ হয়ে যেতে পারে। প্রসঙ্গত, শরীরে টক্সিনের পরিমাণ যত বাড়বে, তত কিডনিকে বেশি মাত্রায় কাজ করতে হবে, ফলে এক সময়ে গিয়ে কিডনি ফেলিওরের আশঙ্কা বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে ডায়াবেটিস এবং ব্লাড প্রেসারের কারণেও কিন্তু এমন ঘটনা ঘটতে পারে। তাই সহজ ভাবে বললে,
রেড মিট = ব্লাড প্রেসার + ডায়াবেটিস + টক্সিন = কিডনি ফেলিওর।
এবার বুঝলেন তো রেড মিটের সঙ্গে কিডনি ফেলিওরের কি সম্পর্ক।
মাংস এবং পশু মোটাতাজা করন:
গরু-ছাগল মোটাতাজা করনের জন্য বিশেষ কিছু হরমোন ও অ্যান্টবায়েটিক খাওয়ানো হয় যা মানুষের শরীরের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর। অনেক মাংস দেখতে খুব নরম এবং অতিরিক্ত ফুলে থাকে। এই সব মাংসে গরু-ছাগল মোটাতাজা করনের মেডিসিন ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই সব মেডিসিন মাংস রান্না করার পরেও কিছুটা অ্যাকশন থাকে যা মানুষের শরীরের জন্য উপযোগী নয়।
মাংস এবং কোষ্ঠকাঠিণ্যতা:
অতিরিক্ত মাংস খেলে পাকস্থলিতে এবং শরীরে পানিশুন্যতা দেখা দেয়। ফলে কোষ্ঠকাঠিণ্যতা দেখা দেয়। অনেকে মাসের পর মাস কোষ্ঠকাঠিণ্যতায় ভুগে থাকেন। তারা মাংস খেলে পায়খানা বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে পেট ফুলে যেতে পারে, পায়ু পথে রক্ত ক্ষরন হতে পারে, জ্বালা-পোড়া করতে পারে এবং পায়খানার চাপ আসা সত্বেও পায়খানা না হওয়াতে মারাত্বক অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
অতিরিক্ত মাংস খেলে bad breath বা মুখের দূর্গন্ধ বেড়ে যায়। এছাড়া অতিরিক্ত মাংস খেলে body odour বা শরীরের দূর্গন্ধও বেড়ে যায়।
মাংস খাওয়া কমানোর কিছু কার্যকরী উপায়:
- বেশি করে শাক-সবজি খাওয়া শুরু করুন। মাংস খেতে খুব ইচ্ছা করলে বেশি পরিমাণ সবজির মধ্যে অল্প করে মাংস মিশিয়ে খান। খেয়াল রাখুন সপ্তাহে মাংস খাওয়ার পরিমাণ যেন ভুলেও ৫০০ গ্রামের বেশি না হয়।
- মাশরুমের মতো সবজি মাংসের মতো করে রান্না করুন। প্রয়োজনে মাছ বেশি করে খান।
- ছুটির দিনে শুধু মাংস খাবেন, এমন সিদ্ধান্ত বাদ দিন।
- একবারে অনেকটা মাংস না কিনে অল্প করে কিনুন। যাতে ইচ্ছা হলেও খেতে না পারেন। আসলে, মাংস খাওয়াটা অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছি এটাই বড় সমস্যা। অভ্যাসটা একটু পরিবর্তন করতে পারলে সব ঠিক। আমাদের ব্রেইনকে অটো সাজেশন দিতে হবে শাকসবজি, ফলমূল ও উদ্ভিজ্জ আমিষ খাবারের প্রতি। মাংসের প্রতি নয়।
পরিশেষে, পরিমান মত মাংস খাওয়া স্বাস্থ্যর জন্য উপকারী। মাংস একটি পুষ্টিকর ও প্রোটিন যুক্ত খাবার। তবে অতিরিক্ত মাংস খাওয়া থেকে দূরে থাকুন। যে কোন পরিবেশে শাক-সবজি খাওয়ার চেষ্টা করুন।