করোনা মহামারীতে মানসিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কিভাবে বৃদ্ধি করবেন।
মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমরা শারীরিকভাবে ভালো থাকার জন্য কত কিছুই না করি। পুরো শরীর পরীক্ষা করে অর্থাৎ মেডিকেল ডায়াগনস্টিক করে হাপসে উঠেছি।
কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের কথা আমরা কখনো ভাবি না। অবসাদ, বিসন্নতা, মনোমালিন্য, ছাড়াছাড়ি মানুষকে এতটা দুর্বল করে দেয় যে, মানুষ একটা সময় আত্মহত্যা করার কথা চিন্তা করে।
করোনাভাইরাস কতটা মারাত্মক, কতটা ছোঁয়াচে তা আর বলার দরকার নেই। এই বিষয়ে আমরা সবাই কম-বেশি অবগত।
সারা বিশ্বব্যাপী এই ভাইরাস যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এবং আমাদেরকে যেভাবে ঘরবন্দি করে দিয়েছে এতে চার দেয়ালে বন্দি থেকে থেকে আমরা মানসিক বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছি।
তাই করোনাভাইরাস প্রতিরোধের জন্য মানসিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মানসিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য করণীয়
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আমাদের সবার মধ্যে রয়েছে। কারো একটু কম আর কারো একটু বেশি।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হলো বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক রোগের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
মানুষ যেহেতু শরীর ও মনের পারস্পরিক সমন্বয়, সেহেতু আমাদের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একই সঙ্গে কাজ করে।
নিজেকে ইতিবাচক কিছু বলুন:
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, আপনি সর্বদা নিজের সম্পর্কে কী ভাবছেন কীভাবে ভাবছেন তা আপনার উপর একটি শক্তিশালী প্রভাব ফেলতে পারে।
আমরা জীবনে ব্যর্থ হওয়ার পর সেটি আর চেষ্টা না করে হাল ছেড়েদি তখন নেতিবাচক অভিজ্ঞতা আমাদেরকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয়।
সফল না হওয়ার পরেও এমন শব্দ ব্যবহার করুন যা নিজ মর্যাদা এবং ব্যক্তিগত শক্তির অনুভূতি প্রকাশ করে। উদাহরণস্বরূপ, “আমি হেরে গেছি বলার পরিবর্তে আমি হারিনি”।
সুসম্পর্ক ও পারস্পরিক সাহায্য:
পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও পাড়া–প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ, ইতিবাচক সম্পর্ক মনকে সব সময় সতেজ রাখে। যতটুকু সম্ভব মানুষকে আন্তরিকভাবে উপকার করার চেষ্টা করতে হবে।
বাস্তবতা মেনে নেওয়া:
বাস্তবতা যতই প্রতিকূল হোক না কেন, তাকে অস্বীকার করে সেখান থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। বরং উল্টো বিভিন্ন মানসিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়।
তাই বর্তমান করোনা সংকটকে এড়িয়ে না গিয়ে বরং চলমান জীবনের একটা অংশ হিসেবে স্বীকার করে নিতে হবে প্রথমেই।
সেখান থেকে একটি ইতিবাচক অর্থ তৈরি করার মাধ্যমে আমরা মানসিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারি।
সৃজনশীল হোন:
আত্নবিশ্বাস বৃদ্ধির জন্য সৃজনশীল কাজ করার চেষ্টা করতে হবে। নিজে নতুন কিছু করতে পারলে শরীর মনে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। গাইতে গাইতে গায়েন, লিখতে লিখতে লেখক।
তেমনি আপনি যে কাজের সাথেই যুক্ত থাকেন না কেন, লেগে থাকুন। করতে করতে আপনার ভেতর থেকে নতুন কিছু বেরিয়ে আসবে।
যোগব্যায়াম বা ধ্যান করুন:
নিয়মিত যোগব্যায়াম করুন। প্রথমে নিঃশ্বাসের ব্যায়াম দিয়ে শুরু করুন। অনুলম বিলম, ভস্ত্রিকা, কাপালভাতি। এতে সমস্ত শরীরে অক্সিজেন প্রবাহ নিশ্চিত হয়।
ধ্যানাসনগুলি অন্ততঃ দিনে কিছুক্ষন করার চেষ্টা করুন। নিয়মিত যোগব্যায়াম আমাদের হরমোন এন্ডোরফিনস, ডোপামিন এবং সেরোটোনিন নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়।
প্রকৃতির সাথে সময় কাটান:
প্রকৃতির সাথে সময় কাটালে শক্তির স্তর বৃদ্ধি, হতাশা হ্রাস করতে পারে এবং সুস্থ্যভাবে বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায়।
আমরা জানি, সকালের রোদটাই নিরাপদ। প্রতিদিন সকালে ১৫ থেকে ৩০ মিনিট রোদ গায়ে লাগান।
সূর্যের আলো ভিটামিন ডি সংশ্লেষ করে, যা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একটি মুড ভালো রাখার নিয়ামক।
সূর্যের আলো আপনার শরীরকে ভিটামিন ডি তৈরিতে সহায়তা করে যা মস্তিস্কে আপনার সেরোটোনিনের মাত্রা বাড়ায়।
সাহস বাড়ান চিন্তার সাগরে ঝাঁপ দেবেন না :
এই সময় মনে বিভিন্ন খারাপ চিন্তা আসতে পারে। কিন্তু তার উপরে সাহসকে রাখতে হবে। চাকরিটা কি থাকবে? ঘরে বয়স্ক অসুস্থ্য বাবা-মা।
এই মহামারীর ভেতরে কিভাবে তাদের ডাক্তারের কাছে নিবো, চিকিৎসা করবো। বাচ্চারা ছোটো ছোটো।
বাচ্চাদেরতো বিভিন্ন সমস্যা লেগেই থাকে। একটা কিছু হলে কি করবো। বাইরে বেরোলে যদি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যাই।
বিপর্যয়মূলক চিন্তা না করে সাহস নিয়ে এগিয়ে যান দেখবেন একসময় অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে।
দৈনিক কমপক্ষে ৭-৮ ঘন্টা ঘুমান:
সঠিক সময়ে দৈনিক কমপক্ষে আট ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, পর্যাপ্ত ঘুম, মানসিক ও শারীরিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
নিজের কাপড়চোপড় নিজে ধোয়া, নিজের রুম নিজে পরিষ্কার করার অভ্যাস করতে হবে। বাড়ির কাজে অন্যকে সাহায্য করতে হবে, যা আপনার একটি দিনকে অর্থপূর্ণ করতে সাহায্য করবে।
ভাল খাবার খান:
আপনি যা খান তা আপনার মস্তিষ্ক সহ পুরো শরীরকে পুষ্ট করে। কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার সেরোটোনিন বাড়ায়, এটি এমন একটি রাসায়নিক যা আপনার মেজাজে শান্ত প্রভাব ফেলে থাকে।
প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার হরমোন উৎপাদন বাড়ায় যা আপনাকে সজাগ রাখতে সহায়তা করে।
শাকসবজি এবং ফলগুলি আপনার দেহের প্রতিটি কোষকে পুষ্ট করে, যা মেজাজ-নিয়ন্ত্রণকারী মস্তিষ্কের রাসায়নিকগুলিকে প্রভাবিত করে।
ওমেগা -৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ সামুদ্রিক মাছ, বাদাম (চীনা বাদাম,কাজু, আলমন্ড), বীজ (ফ্লাক্স সীডস, কুমড়োর বীজ, তিল, সূর্যমুখীর বীজ) খাবারগুলি অন্তর্ভুক্ত করুন।
গবেষণাটি দেখায় যে, এই পুষ্টিগুলি মেজাজকে উন্নত করতে পারে।
এন্ডোরফিন হরমোনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করুন:
এন্ডোরফিন নামক হরমোন আমাদের শরীরকে আনন্দিত করে তোলে। মনমেজাজ ভালো রাখে।
এন্ডোরফিনস হল একটি পেপটাইড হরমোন যেটি মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর শরীরে তৈরি হয়। মস্তিষ্কে এবং পিটুইটারি গ্রন্থিতে অ্যান্ডোরফিন উৎপাদিত হয়।
নিয়মিত ও ধারাবাহিকভাবে ব্যায়াম করলে মস্তিস্ক থেকে এই হরমোনটি নিঃসৃত হয়। স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, হাসিখুশি থাকা এন্ডোরফিন উৎপাদনে ভূমিকা রাখে।
পারিপার্শ্বিক চাপ মোকাবিলার কৌশল হিসেবে বা সাময়িক দুঃখ, কষ্ট ভুলে থাকার জন্য কোনো ধরনের মাদকদ্রব্য ও মাত্রাতিরিক্ত চা-কফি পান করবেন না।
যেসব বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে চাপ তৈরি হচ্ছে, সেই সব উৎসকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে চিহ্নিত করতে হবে। জীবে প্রেম অর্থাৎ পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী ও প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হবে।
সূত্রঃ psychologytoday, medlineplus