বাংলাদেশের পাল সম্প্রদায় (কুমাররা) জীবনের দাবী আর শিল্পের গরীমায় এখনও দীপ্তমান।
মৃৎশিল্পের উৎপত্তি
যদি প্রশ্ন করা হয় পৃথিবীর সর্বপ্রথম হস্তশিল্প কোনটি? এককথায় উত্তর আসবে clay pot বা মৃৎপাত্র। মাটি দামে সস্তা এবং পৃথিবীর সর্বত্র পাওয়া যায়। থালা,বাটি,পানি রাখার পাত্র এই রকম নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চাহিদা থেকে মৃৎশিল্পের উৎপত্তি। আর চাকা আবিষ্কার হওয়ার সাথে সাথে মাটির পাত্র তৈরি অনেক সহজ হয়ে যায়।
মৃৎশিল্পে চাকার ব্যবহার
চাকা আবিষ্কার আধুনিক মানব সভ্যতার জন্য সব থেকে বড় অর্জন। আদিম মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে এবং স্বাভাবিক নিয়মে সভ্যতার উন্নয়নের চাবিকাঠি এই চাকা উদ্ভাবন করেন। প্রায় ছয় হাজার বছর আগে সর্বপ্রথম চাকা ঘুরেছিলো মেসোপটেমিয়ায় (বর্তমান ইরাক)।
এই পৃথিবীতে সর্বপ্রথম চাষাবাদ, মাটির পাত্র তৈরী ও যানবাহনে চাকা ব্যবহৃত হয়। চাকার বাহন সর্বপ্রথম পোল্যান্ডে এবং ইউরেশিয়ান অঞ্চলে (eurasian steppes ) দেখা যায়। মৃৎশিল্পে সর্বপ্রথম চাকা ব্যবহার করা হয় মেসোপটেমিয়ায়।
মৃৎশিল্পের উপকরণ
বাংলাদেশে কুমাররা এই চাকা ঘুরিয়েই মৃৎপাত্র বানাই আপন হাতের দক্ষ ছোঁয়ায়। ঘূর্ণায়মান চাকার উপর মাটির মন্ড বসিয়ে এই কুমাররা আলতো স্পর্শে আকৃতি দেয় এক একটি মাটির জিনিসকে।
এক্ষেত্রে তারা অত্যন্ত সাধারণ উপাদান ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেন যেমনঃ বাঁশের তৈরি মোটা বা চিকন কাঠি, বাঁশের লাঠি, সুতা, মাটির তৈরী বিভিন্ন সাঁচ ইত্যাদি। এ যেনো নিপুন হাতে চোখ জুড়িয়ে যাওয়া অসামান্য এক শিল্পকর্ম। ত্রিলক সম্বলিত কুমারের চাকাকে গ্রামবাংলায় বলে চাক।
মৃৎশিল্পের ইতিহাস
পুরাতাত্বিকের ধারণা,আজ থেকে প্রায় ১৪০০০ বছর আগে মৃৎপাত্রের চালু হয়। আগুনে পোড়া কাদাঁমাটিকে কঠিন রূপ নিতে দেখে কৌশলী মানুষ একসময় বুদ্ধি খাটিয়ে তৈরি করে মৃৎপাত্র। মৃৎশিল্প তাই আদিম যুগ থেকে মানবজাতির উত্তরণের সঙ্গী।
পূর্বএশিয়ার-চীন এবং জাপানে সর্বপ্রাচীন মাটির পাত্রের যে নমুনা পাওয়া গেছে তা দেখে অবাক হতে হয়। মাটির পাত্রের উপর এতো কারুকাজ এবং এতটা মজবুত করে তারা তৈরী করেছে যা আপন হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার পরিচয় বহন করে।
পাল পাড়ার প্রায় প্রতিটি উঠান জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে হাঁড়ি, কলসি, বাসন, সরা, পিঠার সাচ, ফুলের টব, পশুপাখি, রকমারী নকশার পুতুল, ধান-চাল রাখার বড়ো পাত্র, দইয়ের মালসাসহ হাজারো পদ যার তালিকা অনেক বড়।
অতীতে মাটির জিনিসের অনেক কদর ছিলো এবং সব মহলে এর কদর ছিলো। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এই পণ্য চাহিদা মিটিয়ে আশপাশের গ্রামে সরবরাহ করা হতো।পণ্যের বিনিময়ে পণ্য কেনাবেচা অতীতে আমাদের সমাজে প্রচলিত ছিল।
পাল সম্প্রদায় তাদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে আশপাশের প্রতিটি গ্রামে যেতো এবং তাদের উৎপাদিত পণ্যের বিনিময়ে ধান, চাল, ডাল, গুড়সহ তাদের দরকারি জিনিস সংগ্রহ করে বিকাল বা সন্ধ্যায় বাড়ি চলে আসত।
বাংলাদেশে মৃৎশিল্প
নদীমাতৃক আমাদের এই বাংলাদেশে ভূতাত্বিক গঠনে পলিমাটির বিশেষ অবদান রয়েছে। ভূমি গঠনে মূল ভূমিকা পালন করে যে মাটি সেই মাটি প্রকৃতি আমাদের দুহাত ভরে দিয়েছে। আর এই সম্পদ কাজে লাগিয়ে পাল সম্প্রদায় বঙ্গভূখন্ডে সুদূর অতীতকাল থেকে মৃৎশিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের ভূখণ্ডে মৃৎশিল্প প্রায় ৩৫০০ বছর আগে বিশেষ শিল্প হিসাবে বিকাশ লাভ করে। মহাস্তানগড়,পাহাড়পুর, ময়নামতি কালের সাক্ষী হয়ে সযত্নে লালন করে চলেছে যে, মৃৎশিল্পে আমরা কতটা উন্নত ছিলাম।
সাধারণত এক ভাগ বেলে মাটির সাথে দুই ভাগ এঁটেল মাটি মেশালে তৈরি হয় উপযোগী মাটি। এক এক এলাকায় এক এক নামে পরিচিত যেমনঃ রাঙামাটি, মৈনামাটি, বালিমাটি, লাচ্চামাটি, এঁটেলমাটি ইত্যাদি। নরম মাটি কেটে, চেঁছে, ছেনে, মসৃন করে প্রথমে বানানো হয় মন্ড। মন্ড থেকে পাত্র তৈরীর উপযুক্ত পরিমান মাটি নিয়ে তৈরী হয় গোলাকার বুটি। পাত্রের ধরণ বুঝে বুটিগুলোকে দেয়া হয় নানারকম প্রাথমিক আকৃতি।
প্রকৃতপক্ষে, মৃৎশিল্পীরা তাদের হাতের জাদুমিশ্রিত শৈল্পিক দক্ষতায় এবং হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা দিয়ে মাটির রুক্ষতাকে কাটিয়ে, মাটির সাথে জলের মিশ্রণে, পরম যত্ন ও মমতায় মাটিকেই এমন এক রূপ দিয়ে থাকে যা আমাদের জীবনের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত।
কুমারবাড়ির মেয়েরা সংসারও সামলায় আবার মাটির কাজও করে। এগুলো তারা বানায় সাঁচ (ডাইস-dise)-এর মাধ্যমে। সরা,চাঁচর,পিঠার ছাচ, ছোট বড় হরেকরকমের দইয়ের মালসা, পয়সা জমানো ব্যাংক, খেজুরের রসের পাত্র ইত্যাদি শতরকমের জিনিস।
ইতিহাসের অনেকটা পথ অতিক্রম করলেও মৃৎশিল্পে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। তৈরির কায়দা কৌশল সহজ সরল আগের মতই। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটা জেলাতেই পাল সম্প্রদায় বসবাস করে। তবে বাগেরহাট, খুলনা, যশোর, ঢাকা, বগুড়া, ও রাজশাহী জেলাতে বেশি বসবাস করে।
মৃৎশিল্পের উৎপাদন ও রপ্তানী
নিত্যপ্রয়োজনীয় ছাড়াও নান্দনিক রং আর নকশায় দেশীয় জীবন সংস্কৃতির ধারা বাঁচিয়ে রেখেছে পাল সম্প্রদায়। এটা তো পেশা নয়, একটা শিল্প- চারু ও কারু শিল্প।
ঐতিহ্যবাহী লোকজ শিল্প হিসাবে প্রতিকৃতি আর খেলনা পুতুল তৈরী করে নিজেদের তৈরী ছাচেঁ।
মাটির তৈরী পুতুল, হাতি, বাঘ, হরিণ, বিড়াল, মাছ, আম,জাম, কাঁঠাল, লিচু, কলা, রান্নাবাটি খেলার হাড়িপাতিল যা শিশুরা মেলাতে বা দোকানে দেখলেই কিনতে চায়। হাজার বছর ধরে এর কদর এখনো সমানভাবে রয়েছে।
স্পেন, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, জার্মানী, আমেরিকা, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশে আমাদের মৃৎপণ্য রপ্তানী হয়ে থাকে। এর থেকে বাংলাদেশ প্রতিবছর ১০০-কোটি টাকার উপরে আয় করছে।
মৃৎশিল্পের অস্তিত্বের সংকট
অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে এই মৃৎশিল্প। তবুও আঁকড়ে ধরে আছে কুমাররা। আগে সহজেই নদী থেকে মাটি সংগ্রহ করা যেত। বড় বড় বিল থেকেও আনা যেতো। এখন টাকা দিয়ে মাটি কিনে কিভাবে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখবে। এজন্য অতিশীঘ্র সরকারকে এই বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিৎ। কারণ আজও মাটির জিনিস অনেক সমাদৃত। ব্যবহার করা হয় ঘর-গৃহস্থলীর অনেক কাজে।
মৃৎপাত্র বানানোর পর শুরু হয় রোদে শুকানোর পালা। সমস্ত উঠান জুড়ে পাত্র বিছিয়ে রোদে শুকিয়ে শক্ত করা হয়। এরপর নানারকম রং যেমনঃ লালমাটি, গাছের ছাল, দস্তা ও অন্য যৌগের মিশ্রণ, খয়ের, সোডা ইত্যাদি দিয়ে বাহিরের রূপটাকে সুন্দর করে তোলে।
এরপর চুলায় পোড়ানোর পালা। এই বিশেষ চুলা পইন, পুন, পাজাল, পুনসেল ইত্যাদি নামে পরিচিত। পাত্র চুলায় সাজানোর পর খড় ও কাদার আস্তরণ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয় যাতে তাপ বেরিয়ে যেতে না পারে। এখানে কর্মযজ্ঞ চলে সারা দিনরাত জুড়ে। পইনের আগুনে যেভাবে পোড়ে মৃৎপাত্র তেমনি বাস্তবতার আগুনে পোড়ে পাল সম্প্রদায়ের জীবন।
আধুনিকতার নির্মম স্পর্শে হারিয়ে যেতে বসেছে এই শিল্পের কদর। দিন দিন বিলুপ্তির দিকে এগোচ্ছে। অসহায় ও নিঃস্ব হতে চলেছে এই পেশায় যুক্ত মানুষগুলো। হাজারো চিন্তা-টেনশন মাথায়- বাপ-দাদার এই পেশা টিকিয়ে রাখতে পারবো তো?
পরিবেশবান্ধব মাটির জিনিসের চাহিদা দিন দিন কমে যাচ্ছে। প্লাষ্টিক, অ্যালুমিনিয়াম ও মেলামাইনের ব্যবহার প্রচুর পরিমানে বেড়ে গেছে। এই প্লাষ্টিকই পরিবেশের সবথেকে বড় ক্ষতি করছে। মাটির পাত্রের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এই শিল্প এখন হুমকির মুখে।
নতুন প্রজন্ম তাই এই পেশা ছেড়ে দিচ্ছে। সরকার এদিকে নজর দিলে হয়তো পুরোনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব। শতবৈরীতার মাঝেও কুমাররা ধরে রেখেছে বংশানুক্রমিক এই পেশা। কি করে ছাড়বে। এর সাথে তো নাড়ির সম্পর্ক। ঐতিহ্যের শেকড়।
মৃৎপাত্র তৈরীর ভিডিও
হাজার বছরের ঐতিহ্য, ইতিহাস, আর সৌন্দর্যবোধ মেশানো কুমাররা এই পেশা আঁকড়ে ধরে আছে জীবনভর। যেন নদীর মতো বয়ে চলেছে জীবন সংস্কৃতির বর্ণাঢ্য এক ধারা। এই ধারা যেনো থামবার নয়। আত্মার সাথে আত্মার বন্ধন। সেই ধারার অফুরান ঐশ্বর্যে অনন্য গরিমায় পয়মন্ত এই আমার বাংলাদেশ।