বয়স অল্প কিন্তু এতো মোটা। শিশুর স্থূলতা দূর করতে করণীয় কি?
শৈশব স্থূলত্ব একটি গুরুতর মেডিক্যাল কন্ডিশন যা শিশু এবং কৈশোরবস্থাকে প্রভাবিত করে। যে সব শিশু স্থূলকায় তারা বয়স এবং উচ্চতার তুলনায় স্বাভাবিক ওজনের উর্ধ্বে।
শৈশবকালে স্থূলত্ব বিশেষত উদ্বেগজনক কারণ অতিরিক্ত ওজন প্রায়শই শিশুদের বিভিন্ন স্বাস্থ্যের সমস্যার দিকে চালিত করে যেগুলি বয়স্কদের সমস্যা হিসাবে বিবেচিত হত যেমনঃ – ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং উচ্চ কোলেস্টেরল। অনেক স্থূলকায় বাচ্চা স্থূল প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠে, বিশেষত যদি বাবা মা উভয়ই স্থূল হয়।
শৈশবে স্থূলতা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি:
শৈশবকালে স্থূলত্ব আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়া এবং এমনকি আফ্রিকার বিভিন্ন অংশ জুড়ে নতুন সহস্রাব্দের বিশ্বব্যাপী মহামারী হিসাবে উদ্ভূত হচ্ছে। তবুও, এই বিষয়টিতে বই / মনোগ্রাফগুলির একটি আশ্চর্যজনক ঘাটতি রয়েছে, কারণ শৈশবকালের স্থূলত্ব ঐতিহ্যগতভাবে মূলধারার চিকিৎসার বিষয় হিসাবে দেখা হয়নি।
শৈশবকালে স্থূলত্ব সাধারণত একটি বিক্ষিপ্ত সমস্যা হিসাবে বিবেচিত হয়। সংবাদপত্রে লেখালেখি, বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে আলোচনা সমালোচনাসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ভাইরাল আকারে দ্রুত উপস্থাপনের ফলে এটি এখন শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের সম্ভাব্য গুরুতর আধুনিক রোগ হিসাবে দেখা হয় এবং এটি জনস্বাস্থ্যের উপর এক বড় উদ্বেগ হিসাবেও দেখা যায়।
শৈশব স্থূলত্ব (child obesity) একটি জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা। এটি তখন ঘটে যখন কোনও শিশু তার বয়স এবং উচ্চতার তুলনায় স্বাভাবিক বা স্বাস্থ্যকর ওজনের চেয়ে অনেক বেশী থাকে।
জীবন থেকে নেওয়া উদহারণ:
প্রিয়ন্তির বয়স আট বছর। দিন দিন মোটা হয়ে যাচ্ছে। তার ওজন ৫২ কেজি। ক্লাস থ্রীতে পড়ে। ক্লাসে সে সবার থেকে মোটা। মাঝেমধ্যে এর জন্য তাকে বিব্রতও হতে হয়। মা -বাবাও এটা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। বুঝতে পারছেন না কি করবেন। এটা নিয়ে মন সবসময় খারাপ থাকে।
এই যে বয়সের তুলনায় ওজন বেশি এটাকে আমরা বলি চাইল্ড ওবেসিটি বা স্থূলতা। শিশু ও কিশোরদের মধ্যে স্থূলতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। স্থূলতা অনেক ধরণের শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করে। অনেকেই প্রশ্ন করতে থাকে।
স্থূলতার কারণগুলোকে তিনভাগে ভাগ করতে পারি :
- হরমোনজনিত কারণ
- বংশানুক্রমিক ধারা
- পরিবেশগত কারণ (খাদ্যাভাস, শারীরিক শ্রম না করা, দৈনন্দিন জীবনাচরণ ইত্যাদি।)
অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে এমন বিষয়গুলির মধ্যে উচ্চ-ক্যালোরি, কম পুষ্টিযুক্ত খাবার খাওয়া, কোমল পানীয় খাওয়া, পর্যাপ্ত শারীরিক ক্রিয়াকলাপ না করে টেলিভিশন বা অন্যান্য স্ক্রিন ডিভাইস দেখা, ওষুধের ব্যবহার এবং পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব অন্তর্ভুক্ত।
স্থূলকায় শিশুদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি
স্থূলকায় শিশুদের যথেষ্ট স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে। নিচে স্থূলকায় শিশুদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে আলোচনা করা হল:
বর্তমান স্বাস্থ্য ঝুঁকি:
শৈশবকালে স্থূলত্ব বিভিন্নভাবে শরীরের উপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলতে পারে। যেসব শিশুদের স্থূলত্ব রয়েছে তাদের মধ্যে বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে–
- উচ্চ রক্তচাপ এবং উচ্চ কোলেস্টেরল যা কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ (সিভিডি) এর ঝুঁকিপূর্ণ কারণ।
- টাইপ 2 ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায় এবং হাড় ও গিটে ব্যাথা।
- হাঁপানি এবং শাসকষ্ট, ঘুম ঘুম ভাব, ঘুমের ভেতর নাক ডাকা, ঘুমের ভেতর শ্বাসকষ্ট হওয়া।
- ফ্যাটি লিভার ডিজিজ, পিত্তথলির পাথর এবং গ্যাস্ট্রো-এ্যাসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স (অর্থাৎ অম্বল)।
- উদ্বেগ এবং হতাশার মতো মানসিক সমস্যা।
- স্ব-সম্মান কম এবং জীবনের মর্যাদা কমে যাওয়া।
- ধর্ষণ ও কলঙ্কের মতো সামাজিক সমস্যা।
- পেটে চর্বি জমে লিভারের স্থায়ী সমস্যা।
- অল্প বয়সে দাড়ি-গোঁফ ওঠা বা মেয়েশিশুদের মাসিক হয়ে যাওয়া।
- ঘাড় ও ভাঁজে ভাঁজে কালো দাগ দেখা দেওয়া।
- শারীরিক ও মানসিক অবসাদ।
ভবিষ্যতের স্বাস্থ্য ঝুঁকি :
- যেসব শিশুদের মধ্যে স্থূলত্ব রয়েছে তাদের স্থূলত্বের সাথে বয়স্ক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
- যদি বাচ্চাদের স্থূলত্ব থাকে তবে যৌবনে তাদের স্থূলত্ব এবং রোগের ঝুঁকির কারণগুলি আরও গুরুতর হওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যায়।
স্থূলতা রোধে মা-বাবার করণীয় :
আপনার শিশু কি অতিরিক্ত মোটা হয়ে যাচ্ছে? শিশুর জীবনাচরণ পরিবর্তন করুন। সঠিক স্বাস্থ্যকর অভ্যাস পালনের মাধ্যমে এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। দেরি না করে নিমলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করুন:
- শিশুকে ছয়মাস পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ানো উচিৎ। কৌটার দুধ বা কৃতিম খাবার খেলে শিশু দ্রুত মোটা হয়ে যায়।
- প্রচুর ফল ও সবজি সরবরাহ করুন। যতবার সম্ভব ঘরে বসে বাড়িতে বানানো খাবার খান।
- খাওয়া সীমাবদ্ধ করুন, বিশেষত ফাস্টফুড রেস্তোঁরা গুলিতে এবং যখন আপনি বাইরে গিয়ে খাবার গ্রহণ করেন তখন কীভাবে স্বাস্থ্যকর খাবার পছন্দ করবেন তা আপনার শিশুকে শিখিয়ে দিন।
- ছয়মাস পার হয়ে গেলে শিশুকে ঘরের খাবার দিতে হবে। কিন্তু খাবারে শাকসবজি-ফলমূল বেশি রাখতে হবে। যদি মনে হয় বাচ্চা অতিরিক্ত মোটা হয়ে যাচ্ছে তাহলে ভাত, রুটি, আলু, মিষ্টি বা মিষ্টি জাতীয় খাবার, চকলেট আইস-ক্রিম, কোমল পানীয়,ফাস্ট ফুড কম করে দিতে হবে।
- বাইরে খেলাধুলার সুযোগ করে দিতে হবে।
- শিশুর নিজের কাজে উৎসাহিত করতে হবে।
- টিভি দেখে কম্পিউটার বা মোবাইলে গেম খেলে বা অন্য কিছু করে বসে বসে সময় নষ্ট না করে। ২ বছরের বেশি বয়সী বাচ্চাদের জন্য টিভি এবং অন্যান্য “স্ক্রিন টাইম” দিনে ২ ঘণ্টারও কম সীমাবদ্ধ করুন এবং ২ বছরের কম বয়সের বাচ্চাদের জন্য টেলিভিশন দেখার অনুমতি দিবেন না।
- আপনার সন্তানের পর্যাপ্ত ঘুম হয় কিনা সেটা খেয়াল করুন।
- আপনার সন্তানের চিনি-মিষ্টিযুক্ত পানীয়গুলি গ্রহণের সীমাবদ্ধ করুন বা সেগুলি এড়িয়ে চলুন।
এছাড়া আপনার শিশুকে বছরে কমপক্ষে একবার ভালো চাইল্ড চেকআপের জন্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। এই ভিজিটের সময় ডাক্তার আপনার সন্তানের উচ্চতা অনুযায়ী ওজন পরিমাপ করেন ও তার বিএমআই (BMI) গণনা করেন।
আপনার সন্তানের বিএমআই (BMI) যদি বাড়তির দিকে থাকে এবং এক বছরের বেশি সময় ধরে তার পারসেন্টাইল র্যাঙ্কে বৃদ্ধি তাহলে সম্ভবত আপনার বাচ্চার অতিরিক্ত ওজন হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।