কন্যা সন্তান জন্মের জন্য কে দায়ী- মা না বাবা?

কন্যা সন্তানের জন্মদানের জন্য দায়ী ‘মা’ – এমন একটা মধ্যযুগীয় মানসিকতা গেঁথে রয়েছে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে।  গ্রামাঞ্চলে তো বটেই, শহরাঞ্চলেও শিক্ষিত সমাজের অবস্থাও একই। কন্যাসন্তানের জন্মের পর মাকেই সহ্য করতে হচ্ছে গঞ্জনা, নির্যাতন৷

গত কয়েকবছরের খবরের দিকে চোখ রাখলেই উঠে আসে একাধিক কন্যাসন্তানের জন্ম দেবার জন্য কীভাবে দোষী করা হচ্ছে মায়েদের৷ উঠতে বসতে নানা ধরনের কটুক্তি ও গঞ্জনা শুনতে হয় তাঁদেরই৷ কখনও কখনও তা মাত্রাও ছাড়িয়ে যায়৷

দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন ভোগ করতে হয় সংসারের এবং পরিবারের নিকটজনদের হাতে৷ কিন্তু কেন? কেন বৈজ্ঞানিক সত্য মানুষ বিশ্বাস করতে চাই না?

আসলে জীববিজ্ঞানের এই বিষয়টা কয়জনইবা জানে। শিক্ষাদীক্ষায় সমৃদ্ধি অর্থাৎ শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে হয়তো এই ধ্যান ধারণা আস্তে আস্তে কমে যাবে।

সেকেলে বিশ্বাস পুত্রসন্তান পরিবারের সম্পদ৷ বংশ রক্ষা হবে আর আয় রোজগার হবে। অনাকাঙ্খিত বোঝা, অপরের গচ্ছিত সম্পদ৷ যত তাড়াতাড়ি তাদের বিদায় করা যায়, ততই মঙ্গল৷ তাই বাল্যবিবাহ প্রথা আজও বন্ধ হয়নি। এই মধ্যযুগীয় মানসিকতার জন্য দায়ী আসলে অশিক্ষা বা কুশিক্ষা৷

ঋতুচক্র যে নারীদেহের এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, সেবিষয়ে জনশিক্ষার অভাব৷ আর সে কারণেই কন্যাসন্তানের জন্মদান এক ট্যাবুতে রূপান্তরিত হয়েছে৷ অথচ বিশ্বে মেয়েরা আজ পুরুষের সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে চলেছে৷ শিক্ষায়, দীক্ষায়, কর্মদক্ষতায়, মেধায়, প্রতিভায়৷ অথচ সমাজের একটা অংশ সেটা দেখতে চায় না, চায় না মেয়েদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে৷

সবথেকে বড় কথা পুত্র ও কন্যাসন্তানের জন্মে জীববিজ্ঞানের ব্যাখ্যা কী? প্রত্যেক মানুষের ডিএনএ-তে এক জোড়া সেক্স-ক্রোমোজোম থাকে, যার একটির নাম ‘এক্স’ অন্যটির নাম ‘ওয়াই’৷ এক্স ও ওয়াই ক্রোমোজোম দিয়ে গঠিত হয় পুরুষ শরীর৷ আর নারী দেহে থাকে দুটোই ওয়াই ক্রোমোজোন৷

তাই নারী-পুরুষের মিলনের সময় সন্তানের ভ্রুণে বাবার থেকে এক্স ও মায়ের থেকে ওয়াই ক্রোমোজোম নিয়ে এক্স-ওয়াই যুগল অথবা দুজনের থেকে ওয়াই ক্রোমোজোন নিয়ে ওয়াই-ওয়াই যুগল তৈরি হতে পারে৷ এক্স-ওয়াই যুগলে পুত্রসন্তান আর ওয়াই-ওয়াই যুগলে কন্যাসন্তান হয়৷ ঘুরিয়ে বলতে গেলে সন্তানের লিঙ্গ গঠনে বাবারই পরোক্ষ অবদান করেছে, মায়ের নয়৷

বিজ্ঞানের আলোকে একটু বিশ্লেষণ করে জেনে নিই। আমরা জানি প্রত্যেকটি মানুষের শরীরে ৪৬ টি ক্রোমোজম থাকে। সেগুলো দুই প্রকারের। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এগুলোকে x ও y নামে অভিহিত করা হয়। নারীর দেহে থাকে ৪৬ টি x ক্রোমোজম। আর পুরুষের শরীরে থাকে ২৩ টি x ও ২৩ টি y, যখন কোন পুরুষ ও নারীর দৈহিক মিলন ঘটে তখন স্বামীর থেকে ২৩ টি x এবং স্ত্রীর থেকে ২৩ টি x এসে যে সন্তান হয় তা হলো মেয়ে।

আর যদি নারীর থেকে ২৩ টি x ও স্বামীর থেকে ২৩ টি y আসে তাহলে, সন্তান হয় ছেলে। তাহলে, আমরা দেখতে পায় যে, এটা পুরোপুরি স্বামীর অবস্থার উপর নির্ভর করবে।

দায়ী যদি কাউকে করতেই হয় তাহলে, এর জন্য দায়ী স্বামী; স্ত্রী নয়। কেননা, স্বামীর শরীর থেকে x আসার কারণেই মেয়ে হয়েছে। আর যদি y আসত তাহলে সন্তান ছেলে হত। এ জন্যই টেস্ট টিউব সন্তানের বেলায় ডাক্তাররা কখনো কখনো বীর্য থেকে x ও y ক্রোমোজম আলাদা করে সন্তান ছেলে বা মেয়ে হওয়াতে প্রভাব সৃষ্টি করেন।

আমাদের দেশে বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে বাড়ির নারীরা তাদের ছেলেকে প্ররোচনা দিয়ে থাকেন যে, এবার মেয়ে হলে তোমার বউকে তালাক দিয়ে দাও। এমন ছন্নছাড়াকে বাড়িতে আর রেখ না। ইত্যাদি আরও কত কি! আগন্তুক কন্যা সন্তান দুনিয়ায় এসে কখনো জানতে পারেন তার দাদি কিংবা নিকটাত্মীয়দের এসব কথা তাহলে- তার মনে কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে?

এরপরেও কি তার মনে ঐ ব্যক্তিদের প্রতি কোন ভক্তি শ্রদ্ধা অবশিষ্ট থাকতে পারে? যে নারীরা এ কথা বলে থাকেন তাদেরও জানা উচিত যে, সে নিজেও নারী। সে নিজে নারী হওয়া সত্ত্বেও আরেকজন মেয়ের আগমণে তার এ ধরণের কথাবার্তা মানায় না।