একাই একটি দুর্গ।

একাই একটি দুর্গ

—————————

এপ্রিল ১৯৭১।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এগিয়ে আসছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে। তাদের ঠেকানোর জন্য মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নিয়েছেন দরুইন গ্রামে। দলে মাত্র দশ জন সৈন্য। অধিনায়ক সিপাহি মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল।

৭ই মার্চ ভাষণ দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওই ভাষণে তিনি স্বাধীনতা- সংগ্রামের ডাক দেন। মোস্তফা কামাল তখন চব্বিশ বছরের যুবক। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে তাঁর বুক ফুলে ওঠে।

১৬ই এপ্রিল ১৯৭১।
মোস্তফা কামাল খবর পেলেন পাকিস্তানি বাহিনী কুমিল্লার আখাউড়া রেললাইন ধরে এগিয়ে আসছে। চাইছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখল করতে।

১৭ই এপ্রিল ১৯৭১।
ভোর থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর গোলাবর্ষণ শুরু করলো। মোস্তফা কামাল ভাবতে লাগলেন। এত কম শক্তি নিয়ে ওদের মোকাবিলা করা যাবে না। খবর পাঠালেন জরুরি সেনা সহায়তার জন্য।

কিন্তু বাড়তি সেনা এলো না। এমনকি দুই দিন ধরে নিয়মিত খাবারও বন্ধ। চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলেন তিনি। সকলে মিলে আত্মরক্ষা করলেন পরিখার মধ্যে।

দুপুরের দিকে বাড়তি কয়েকজন সেনা দরুইনে এসে পৌঁছালেন। সেই সঙ্গে খাবারও এলো। পাকিস্তানি ঘাঁটি থেকে গোলাবর্ষণও হলো বন্ধ।

১৮ই এপ্রিল ১৯৭১।
সকালবেলা সারা আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেল। মুক্তিযোদ্ধারা ভাবলেন, বৃষ্টি এলে দুশমনদের হামলা থেকে কিছুটা রেহাই মিলবে।

সারা সকাল নির্বিঘ্নে কাটল। পাকিস্তানি বাহিনীর কোনো রকম গোলাবর্ষণ হলো না।

বেলা এগারোটা। শুরু হলো প্রচন্ড বৃষ্টি। আর সেই সঙ্গে শত্রুর গোলাবর্ষণ। এগিয়ে আসতে লাগলো পাকিস্তানি বাহিনী। বেলা বারোটা। আক্রমণ হলো আরও তীব্র। মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টা গুলি তার সামনে কিছুই না।

হটাৎ একটা গুলি এসে বিঁধল এক মুক্তিযোদ্ধার বুকে। তিনি মেশিনগান চালাচ্ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেলো মেশিনগান। মোস্তফা কামাল পাশেই ছিলেন। তিনি এক মুহূর্তও দেরি না করে চালাতে লাগলেন মেশিনগান।

পাকিস্তানি সৈন্যরা সংখ্যায় অনেক। সঙ্গে ভারী অস্ত্রশস্ত্র। মুক্তিযোদ্ধারা সংখ্যায় কম। ভারী অস্ত্রশস্ত্র তেমন নেই। তাঁদের হয় সামনাসামনি যুদ্ধ করতে হবে আর না হয় পিছু হাটতে হবে।

কিন্তু পিছু হাটতে চাইলেও কিছুটা সময় দরকার। ততক্ষন অবিরাম গুলি চালিয়ে ঠেকিয়ে রাখতে হবে দুশমনদের। এ দায়িত্ব কে নেবে?

এ সময় আরও একজন ঢলে পড়লেন শত্রুর গুলিতে। মোস্তফা কামাল পরিখার মধ্যে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চালাতে লাগলেন গুলি। নয়জন মুক্তিযোদ্ধা এর মধ্যেই শহিদ হয়েছেন। পিছু না হাটলে সবার মৃত্যু অবধারিত।

মোস্তফা কামাল সবাইকে সরে যেতে বললেন। তিনি একা গুলি চালিয়ে যাবেন। মোস্তফা কামাল জোর দিয়ে বললেন, আপনাদের পিছু হাটতেই হবে। তা না হলে দুশমনরা সবাইকে শেষ করে দিবে। তিনি আবার আদেশ দিলেন, সবাই দ্রুত সরে যান।

শেষ পর্যন্ত মোস্তফা কামালকে রেখে সবাই খুব সাবধানে পিছু হাটলেন।

অনবরত গুলি চালিয়ে যাচ্ছেন মোস্তফা কামাল। তিনি একাই যেন মুক্তিবাহিনীর একটা দুর্গ। এক সময় গুলি শেষ হয়ে গেলো। হটাৎ একটা গোলা এসে পড়ল পরিখার মধ্যে। গোলার আঘাতে তাঁর শরীর ঝাঁঝরা হয়ে গেল। তিনি মৃতুবরণ করলেন।

দরুইনের মাটিতে সমাহিত হয়ে আছে মোস্তফা কামালের ক্ষতবিক্ষত দেহ। তাঁর আত্মদানের কথা আমরা কোনো দিন ভুলবো না।

তিনি আমাদের গৌরব। তিনি আমাদের অকুতোভয় বীর। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ “বীরশ্রেষ্ঠ” খেতাবে ভূষিত করে।