স্টিমারের সিটির গল্প।
স্টিমারের সিটি
—————————
বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। অনেক দিন স্কুল ছুটি। মা-বাবা এই ছুটিতে ঢাকার বাইরে কোথাও বেড়ানোর কথা বললেন। আমরা আনন্দে নেচে উঠলাম। ঠিক হলো, আমরা নদীপথে চাঁদপুরে যাবো। নদীপথে ভ্রমণের নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করবো। বাবা জানালেন, আমাদের ভ্রমণ হবে রকেট স্টিমারে। এটিও আমাদের সকলের জন্য খুবই খুশির খবর। অনেকের কাছে গল্প শুনেছি, রকেট স্টিমারে চড়ার মজাই আলাদা।
শীতের সকাল। আটটার মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম ঢাকার সদরঘাটে। মা-বাবার সঙ্গে আমার ছোট ভাই তনু ও ছোট বোন নিনা। সাড়ে আটটায় ছাড়বে স্টিমার। স্টিমার ছাড়ার আগেই আমরা নিচতলা ও দোতলায় ডেকে ঘুরে বেড়ালাম।
এর মধ্যে হঠাৎ ভোঁ করে স্টিমারের সিটি বাজল। স্টিমার ছাড়ার সময় হলো। স্টিমারের দুই পাশে চাকা। চাকার অর্ধেকটা পানির মধ্যে, বাকিটা ওপরে। দুটি চাকা ঘুরে স্টিমারকে সচল করে তুলল। এটি দেখার মতো একটি দৃশ্য।
স্টিমার ক্রমশ সদরঘাট পেরিয়ে এগিয়ে চলছে। দেখলাম বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর ব্রিজ। তার নিচ দিয়ে আমাদের স্টিমার যাচ্ছে। সেও এক সুন্দর দৃশ্য।
যেতে যেতে বুড়িগঙ্গার দুই পাড়ের দৃশ্য দেখছি আমরা। তারপর একসময় স্টিমার এলো মুন্সিগঞ্জে। দেখা গেল ধলেশ্বরী নদীর মোহনা। তারপর আরও একটু এগিয়ে দেখা গেল নারায়ণগঞ্জ। পৌঁছে গেলাম শীতলক্ষ্যা নদীর মোহনায়। স্টিমার একসময় মেঘনা নদীতে পড়লো। দুই তীরের দৃশ্যে আমাদের চোখ জুড়িয়ে গেল। একদিকে শ্যামল শস্যের বিস্তীর্ণ মাঠ, আরেক দিকে দূরে গাছপালায় ঘেরা গ্রাম। মাঝখানে নদীর বিপুল জলধারা।
স্টিমার যতই এগোচ্ছে নদী ততই প্রশস্ত হচ্ছে। নদীর পানির ওপরে সাদা গাঙচিল উড়ে বেড়াচ্ছে। তারা কখনো ঝাঁক বেঁধে স্টিমারের পিছনে পিছনে উড়ে চলছে। নদীতে দেখা গেল এক ধরণের প্রাণী। পানির ওপর একটু উঠেই আবার ডুবে যাচ্ছে। বাবা বললেন, এগুলোর নাম শুশুক।
নদীতে চলাচল করছে নানা আকারের নৌকা ও লঞ্চ। নৌকায় করে জেলেরা মাছ ধরছে। লঞ্চে চড়েছে যাত্রীরা। তরতর করে এগিয়ে চলে স্টিমার।
তনু বাইনোকুলার দিয়ে নদী ও নদীতীরের দৃশ্য দেখছে। আর নিনা ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছে। স্টিমার থেকে তীরের ঘরবাড়িগুলো খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে নদীর ঘটে মানুষ গোসল করছে। কোথাও মহিলারা কাপড় ধুচ্ছে। কোনো ঘাটে আবার যাত্রীবাহী নৌকা ভেড়ানো। যাত্রীরা তাতে ওঠানামা করছে।
আমি, তনু ও নিনা একসময় উঠে গেলাম স্টিমারের ছাদে। ছাদে রয়েছে কাপ্তানের আকৃ ছোট ঘর। সেখান থেকেই তিনি স্টিমারের সিটি বাজাচ্ছেন।
মেঘনা নদী যেখানে পদ্মার সঙ্গে মিশেছে সেখানে একসময় এসে গেল স্টিমার। সেখানে এক তীর থেকে আরেক তীর আর দেখা যায় না। শুধু পানি আর পানি। এর কাছেই চাঁদপুর। স্টিমার চলে এলো চাঁদপুরের কাছে। চাঁদপুর ইলিশ মাছ ও নদীবন্দরের জন্য বিখ্যাত। মেঘনা নদী থেকে স্টিমার ঢুকবে একটি ছোট নদীতে। নদীটির নাম ডাকাতিয়া। নদীতে খুবই স্রোত। স্টিমারের গতি কমে গেল। আবার বেজে উঠল স্টিমারের সিটি। ধীরে ধীরে ঘাটে এসে ভিড়ল স্টিমার। এর মধ্যে শুরু হলো লাল জামা পরা কুলিদের হইচই। এবার আমাদের নামার পালা। শেষ হলো আমাদের আনন্দ ভ্রমণ।