রাত জাগলে স্বাস্থ্যের যেসব ক্ষতি হয়।
শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য পর্যাপ্ত ঘুম, আহার ও বিশ্রাম দরকার। ঘুম কম হলে শরীরের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। তাই স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে হলে রাত জাগার এই ‘বদঅভ্যাস’ পরিবর্তন করতে হবে। মাঝেমধ্যে দু’একদিন রাত জাগলে তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। তবে একটানা দীর্ঘদিন রাত জাগলে ভয়াবহ শরীরিক ক্ষতি হতে পারে।
রাত জাগলে সারা দিন ঘুম ঘুম ভাব কাজ করে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। আলস্য কাজ করে, ব্যায়ামের ইচ্ছে থাকে না। ফলে ওজন বাড়তে পারে। তাছাড়া ইদানিং যুব সমাজে একটি কালচার গড়ে উঠেছে, সেটি হলো রাত জাগা।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, হঠাৎ দু-একদিন জরুরি প্রয়োজনে রাত জাগতে হতেই পারে। কিন্তু ক্রমাগত রাত জাগার ফলে একজন মানুষের দেহে দেখা দিতে পারে মারাত্মক রোগব্যাধি। এর পরিণতিতে রাত জাগা ব্যক্তি আক্রান্ত হন স্লিপ ডিজঅর্ডার, অপরিণত বয়সে হৃদরোগ, বিষন্নতা এমনকি পারিবারিক অশান্তিতে।
স্মৃতিশক্তি, সৃজনশীলতা, প্রাণবন্ততা, কর্মতৎপরতা কমে যায় রাত জাগার ফলে। অন্যদিকে স্বাভাবিকভাবে প্রতিদিন পরিমিত ঘুম ও বিশ্রাম হলে স্মৃতিশক্তি হয়ে ওঠে সংহত এবং তা প্রয়োজনের সময় কাজও করে ভালোভাবে।
প্রকৃতগত নিয়ম হচ্ছে দিনে কাজ করা, আর রাতে ঘুম। সব ক্লান্তি দূর করে আবার কাজ করার শক্তিও যোগায় ঘুম। কিন্তু আপনি যখন ক্রমাগত রাত জাগবেন তখন জ্বর জ্বর ভাব, ঠান্ডা লাগা, এসিডিটির পাশাপাশি দুর্বল হতে থাকবে আপনার শরীর।
মানবদেহের বিভিন্ন হরমোন ও এনজাইম রাত-দিন ভেদে কার্যক্রম চালিয়ে থাকে। কর্টিসোল স্বাস্থ্যগত কার্যক্রমে অত্যন্ত প্রভাব বিস্তারকারী। এ হরমোনটির নিঃসরণ-মাত্রা দিনের প্রথমার্ধে থাকে সর্বোচ্চ পরিমাণে এবং এরপর থেকে কমতে থাকে। কিন্তু টানা রাত জাগরণের ফলে এই প্রাকৃতিক নিয়ম পাল্টে যায়।
আসুন জেনে নিই দীর্ঘদিন রাত জাগলে যত ক্ষতি-
হার্টের সমস্যা হয়:
বর্তমান প্রজন্মের একটি সাধারণ অভ্যাস হচ্ছে অকারণে রাত জাগা। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব হৃদরোগের মতো দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলোর সাথে এটি সম্পর্ক রয়েছে। বয়সভেদে গড়ে দৈনিক কমপক্ষে ৮ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন।
যারা রাতে ৬ ঘন্টার কম ঘুমায় তাদের উচ্চ রক্তচাপে ভোগার বা নিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার সম্ভবনা খুব বেশী। তাছাড়া রাতজাগা রোগীদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের প্রাদুর্ভাব বেশী দেখা যায়।
কিডনির স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা কমে যায়:
রাত জেগে থাকা, ঘুমাতে না পারা আমাদের অনেকেরই নিয়মিত সমস্যা। কিন্তু ঘুম শরীরের জন্য নানা কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঘুমের সময়ই শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর টিস্যুর নবায়ন ঘটে। ফলে ঘুমাতে না পারার সমস্যাটা নিয়মিত চলতে থাকলে কিডনিসহ শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর এই কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। এতে কিডনির স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা কমে যায়।
অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়:
বেশি দিন বাচঁতে হলে একটানা দীর্ঘদিন কম না ঘুমিয়ে দৈনিক টানা কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে। কোষের ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণ এবং সুন্দর দেহ গঠনে সহায়তা করার জন্য ঘুম গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় জানা গেছে যে, দীর্ঘায়ুত্বে নিয়মিত ঘুম যেমন প্রতিদিন একই সময়ে বিছানায় যাওয়া এবং প্রতিদিন একই সময় জেগে ওঠা।
প্রতি রাতে ৫-৭ ঘন্টারও কম ঘুমানো অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি ১২% বেশি। প্রতি রাতে ৮-৯ ঘন্টা ঘুমানো অকাল ৩৮% পর্যন্ত হ্রাস করতে পারে। খুব কম ঘুম ডায়াবেটিস, হার্টের রোগ এবং স্থূলত্বের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে।
ওজন বৃদ্ধি পায়:
রাত জেগে থাকলে শরীরে কর্টিসল হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যায় যা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আর এই গ্লুকোজের রেসপন্সে বেশী করে ইনসুলিন নিঃসৃত হয়। কিন্তু রাতের বেলা মাংসপেশীর নড়াচড়া কম থাকায় বা খাদ্যের চাহিদা কম থাকায় ইনসুলিন এই গ্লুকোজকে ফ্যাট সেলে চর্বি হিসাবে জমা হতে সাহায্য করে।
দেহের বৃদ্ধি কমে যেতে পারে:
ঘুমের মধ্যে দেহের বৃদ্ধির জন্য দায়ী Growth Hormone এর নিঃসরণ বেশী হয় এবং এসময় দেহের বৃদ্ধির হারও বেশী থাকে। রাতের বেলা উচ্চতা বৃদ্ধির কারণেই অনেক সময় শিশুদের জয়েন্টে ব্যথা হয় (জয়েন্টের কাছাকাছি হাড়ের অংশে দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির জন্য দায়ী এপিফাইসিয়াল প্লেট থাকে যা বৃদ্ধির সময় ব্যথার অনুভূতি তৈরি করে)। সুতরাং যারা রাতে ঠিকমত ঘুমান না (বিশেষত শিশু ও টিনএজারদের ক্ষেত্রে) তাদের দেহের বৃদ্ধি কমে যেতে পারে।
ডায়াবেটিস হয়:
ডায়াবেটিসের অন্যতম প্রধান কারণ ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স। অর্থাৎ ইনসুলিনের প্রতি কোষের সংবেদনশীলতা কমে যাওয়ায় তা ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। গবেষণায় দেখা গেছে পরপর ৪ রাত ঠিকমত না ঘুমালে ইনসুলিনের প্রতি কোষের সংবেদনশীলতা ১৬% কমে যায় যা ওজন বৃদ্ধি, প্রি-ডায়াবেটিক ও ডায়াবেটিক হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায় এবং নিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসকে অনিয়ন্ত্রিত করতে পারে। জাপানের এক গবেষণা পত্রে দেখা যায় রাত জেগে কাজ করা শ্রমিকদের মধ্যে ডায়াবেটিসের প্রাদুর্ভাব দিনে কাজ করা শ্রমিকদের তুলনায় প্রায় ৫০% বেশী।
ব্রেস্ট ও ওভারীর ক্যান্সার হতে পারে:
মার্কিন এক গবেষণায় জানা গেছে যেসব কর্মজীবি নারীরা রাত জেগে কাজ করেন তাদের স্তন ও ডিম্বাশয়ে ক্যান্সারের ঝুঁকি যারা শুধু দিনের বেলায় কাজ করেন তাদের তুলনায় যথাক্রমে ৩০% ও ৪৯% বেশী।
পেটের সমস্যা হয়:
যাদের রাত জাগার অভ্যাস আছে তাদের মধ্যে বুক জ্বালাপোড়া, পেপটিক আলসার, বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, ইরিটেবল বাউয়েল সিনড্রোম (IBS), ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য সহ নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। হজমের সমস্যাগুলি, বিশেষত ব্যথা এবং অ্যাসিডের রিফ্লাক্স থেকে কাশি বা খিটখিটে অন্ত্র সিনড্রোমের লক্ষণ।
ক্লান্তিবোধ:
ঘুম দেহের চার্জ হিসাবে কাজ করে। ঘুমের মাধ্যমে দেহ বিশ্রাম নেয় পরবর্তী সময়ের জন্য দেহকে পূর্ণ কার্যক্ষম করে তোলার জন্য। কিন্তু যারা রাত জাগে এবং পর্যাপ্ত ঘুমায় না তাদের পরবর্তী দিন ক্লান্তিতে ভুগতে দেখা যায়।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়:
দীর্ঘদিন ধরে রাত জাগার কারণে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। বিশেষত, ভাইরাসজনিত রোগবালাইয়ে ভোগার সম্ভবনা বেশ বেড়ে যায়।
প্রদাহ বৃদ্ধি:
যারা রাত জেগে কাজ করেন তাদের রক্তে প্রদাহ বেশী থাকে। কোন কোন গবেষক রাতজাগাকে Low-grade chronic inflammation এর সাথে তুলনা করেছেন। অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন রাত জাগাজনিত যত সমস্যা হয় তার বেশীরভাগ সমস্যার পিছনে রয়েছে এই মৃদু মাত্রায় দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহ। হয়ত এ কারণেই রাত জাগাদের শরীরে জ্বর জ্বর ভাব,শরীর ব্যাথা/ম্যাজম্যাজ করা বা মাথাব্যাথা করার মত উপসর্গ প্রায়ই দেখা দেয়।
মাথাব্যাথা:
যারা রাতে ঠিকমত ঘুমান না তাদের মাথাব্যাথা হওয়ার ও মাইগ্রেনের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা বেশী দেখা যায়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রতি রাতে ছয় ঘণ্টারও কম ঘুমিয়েছে এবং যারা বেশি ঘুমিয়েছে তাদের মধ্যে তুলনা করে দেখা গেছে যে, যারা কম ঘুমিয়েছে তাদের ঘন ঘন এবং তীব্র মাথা ব্যথা ছিল।
স্মৃতিশক্তি কমে যায়:
আমরা সারাদিন যা শিখি বা জানি তা ব্রেনে স্থায়ীভাবে ধরে রাখতে ঘুম অপরিহার্য্য। বর্তমান প্রজন্মের একটি সাধারণ অভ্যাস হচ্ছে অকারণে রাত জাগা। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব ব্রেইন সেল বা নিউরন ধ্বংস করে।
ফলে স্মৃতিশক্তি, সমন্বয় ও মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে। আচরণের উপরেও এটি ব্যাপক প্রভাব ফেলে- মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। বয়সভেদে গড়ে দৈনিক কমপক্ষে ৮ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন।
মানসিক রোগ:
যারা রাতে ঠিকমত ঘুমায় না বা রাত জেগে থাকে তাদের মধ্যে বিষণ্নতা, অস্থিরতা, বিরক্তি সহ নানাবিধ মানসিক রোগের বা উপসর্গের প্রাদুর্ভাব বেশী দেখা যায়। আর যারা ইতোমধ্যে এসব রোগে ভূগছেন তাদের রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়।