মুড়ি শক্তি যোগায়, ওজন কমায় ও হজমশক্তি বৃদ্ধি করে।

বাংলায় “মুড়ি” ইংরেজিতে puffed rice, হিন্দিতে কুড়মুড়া, মুড়মুড়া হিসাবে পরিচিত। খুবই সুস্বাদু, মচমচে ও পুষ্টিকর খাবার হলো এই মুড়ি। স্ট্রিট ফুডের একটি বিখ্যাত আইটেম হলো মুড়ি।

রাস্তায় দাড়িয়ে ঝালমুড়ি বা মুড়িমাখা খাওয়া অনেকের পছন্দের বিশেষ করে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের। এগুলো খুবই হালকা, মচমচে ও সহজে হজম হয়। ভাত খুব বেশি খেলে ক্ষতি। পরিমাণমতো খেলে ক্ষতি নেই, মুড়িও তাই।

মুড়িতে ক্যালোরি কম, সোডিয়ামমুক্ত, কোলেস্টেরোল জিরো পার্সেন্ট, ভাবা যায়। মুড়ি দিয়ে অনেক খাবার তৈরি করা যায়। সকল বয়সীদের মুড়ি খুব পছন্দের। তবে মুড়ি থেকে প্রস্তুতকৃত মুড়ির মোয়া বাচ্চাদের খুবই পছন্দের।

পড়ার টেবিলে পড়া শেষ করতে করতে খুব ক্ষুধা পেয়ে গেলো। মা এনে দিলো এক বাটি মুড়ি ও একটু পাটালি গুড়। ছোট্ট ক্ষিধের বড় সমাধান। এই খাবারের কোনো তুলনা হয় না। আসলে মুড়ি আমাদের বাঙালিদের জীবন ধারার সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত।

কি গ্রাম, কি শহর সকল মানুষের সকাল বিকালের হালকা খাবার হিসাবে ক্ষুধা মেটাতে এর জুড়ি মেলা ভার। চায়ের সাথে বিস্কুট, টোস্ট খেতে খেতে একঘেঁয়ে লাগছে বা বিস্কুটে থাকা চিনি, তেল, সোডিয়াম স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে? চিন্তা নেই। সোডিয়াম ও কোলেস্টেরোল মুক্ত মুড়ি আপনি অনায়াসে খেতে পারেন।

যাদের বার বার ক্ষিধে লাগে তারা মুড়ি খেতে পারেন। মুড়ি অনেকটা পানি টেনে নেই বলে পেট অনেক্ষণ ভরা থাকে। মুড়ি মাখা বা ঝাল মুড়ি-সর্ষের তেল, লবন, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, চানাচুর, টমেটো ও ধনেপাতা কুঁচি, লেবুর রস, রসুন তেল ইত্যাদি সহযোগে মুখরোচক ও পুষ্টিকর।

ইফতারে ছোলা-মুড়ির চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। অনেকে দুধ দিয়ে মুড়ি খেয়ে থাকেন। এর সাথে অল্প একটু গুড়, চিনি ও বাদাম মিশিয়ে খেতে পারেন।

মুড়ি কিভাবে তৈরি করা হয়?

বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্যবাহী পদ্বতি: খুবই সহজ কিন্তু টেকনিকটা না জানলে খুব কঠিন। উপকরণঃ একটা বড় মাটির পাত্র, বালি, লবন ও দেশি মিষ্টি জাতের চাল।

ভাতের থেকে কি মুড়ি ভালো?

আমাদের বাঙালিদের প্রধান খাদ্য হলো ভাত। রাইসকুকার বা প্রেসারকুকারে ফ্যানসহ রান্না করা যে ভাত আমরা প্রতিদিন খেয়ে থাকি তা আমাদের ওজন একটু হলেও বাড়িয়ে দিচ্ছে। টেনশন বেড়ে যাচ্ছে। সেই তুলনায় মুড়ি আপনাকে কিছুটা স্বস্তি দিবে।

এক কাপ মুড়িতে কেবল ৫৪ ক্যালোরি, ০.০৩ গ্রাম ফ্যাট, ১২.২৯ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ০.৯৮ গ্রাম প্রোটিন এবং স্বল্প পরিমাণে ডায়েট্রি ফাইবার এবং আয়রন থাকে যা স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখার জন্য ভালো।

মুড়ি কি ডায়াবেটিস রোগীদের সুগার লেভেল বাড়িয়ে দেয়?

হ্যাঁ, মুড়ি ডায়াবেটিস রোগীদের সুগার লেভেল বাড়িয়ে দেয়। তাই ডায়াবেটিস রোগীরা মুড়ি পরিমাণমতো ও আপনার ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খাবেন। আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন অনুসারে, রোলড ওটমিল, স্টিল-কাট ওটমিল এবং ওট ব্রান এর জিআই (GI) মান ৫৫ বা তারও কম। অর্থাৎ কার্বোহাইড্রেটের মাত্রা কম। কিন্তু কর্ন ফ্লেক্স, puffed rice বা মুড়ি, ব্রান ফ্লেক্স এর কার্বোহাইড্রেটের মাত্রা বেশি থাকে অর্থাৎ উচ্চ জিআই (GI) খাবার হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যার মান ৭০ বা তারও বেশি হয়।

মুড়ি খাওয়ার কিছু স্বাস্থ্য উপকারিতা জেনে নিন :

এটি উচ্চ ফাইবার, প্রোটিন এবং জটিল কার্বসের দুর্দান্ত সংমিশ্রণ। মুড়ি কম ক্যালোরি এবং অতিরিক্ত ভিটামিন এবং খনিজ সমৃদ্ধ। মুড়ি শুধু একটি মুখরোচক খাবার নয় এর রয়েছে নানাবিধ উপকারিতা। যা সাধারণত আমরা জানিনা।

১৪ গ্রাম মুড়িতে রয়েছে ৫৬ ক্যালরি। কার্বোহাইড্রেটস ১২.৬ গ্রাম, প্রোটিন ১ গ্রাম, ফ্যাট মাত্র ০.১ গ্রাম, ফাইবার ০.২ গ্রাম, পটাসিয়াম ১৬ মিলিগ্রাম, আয়রন ৪.৪৪ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম ৪ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ১৪ মিলিগ্রাম, থিয়ামাইন ০.৩৬ মিলিগ্রাম এবং নিয়াসিন ৪.৯৪ মিলিগ্রাম।

মুড়ি শক্তির যোগান দাতা:

চাল থেকে মুড়ি তৈরি হয়। চাল শর্করার দুর্দান্ত উৎস। গ্লাইসেমিক ইনডেক্সে(GI) মুড়ির অবস্থান অনেক উপরে। তাই আমরা সহজেই বুঝতে পারছি মুড়ি শক্তির পাওয়ার হাউস।

মুড়িতে রয়েছে উচ্চ পরিমাণে শর্করা। এটি আমাদের শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। আমাদের প্রতিদিনের কাজে সক্রিয় থাকতে সকাল বা বিকালের টিফিনে মুড়ি হোক আদর্শ খাবার।

মুড়ি এসিডিটির যম বা এসিডিটি কমায়:

অনেকেরই একটা প্রশ্ন রয়েছে। মুড়ি কি গ্যাস সৃষ্টি করে? না মুড়ি গ্যাস সৃষ্টি করে না। সুপ্রাচীনকাল থেকে আমরা ভোজনপ্রিয় বাঙালিরা চাল থেকে মুড়িসহ আরো অনেক খাবার তৈরি করে খেয়ে থাকি। মুড়ি পরিমিত মাত্রায় সেবনে স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব যেমন পাওয়া যায়না তেমনি এর কিছু উপকারিতা রয়েছে।

পুরো শস্য যেমন গম এবং ওটগুলিতে ফাইবার, রাফিনোজ এবং স্টার্চ থাকে। এগুলি সমস্ত বৃহদন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ভেঙে যায়, যা গ্যাসের দিকে পরিচালিত করে। আসলে, চাল একমাত্র দানা যা গ্যাস সৃষ্টি করে না। আর আমরা জানি, মুড়ি সরাসরি চাল থেকে তৈরি হয়।

হজমে সাহায্য করে:

মুড়ি ফাইবার সমৃদ্ধ। এতে প্রতিরোধী স্টার্চ রয়েছে যা বিপাকক্রিয়া বাড়ায়। যাই হোক মুড়ি শরীরের মেটাবলিজমের উন্নতিতেও সাহায্য করে। ফাইবার-প্যাক। পেট ভরিয়ে রাখে। মুড়ি স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখতে সহায়তা করে। পেঁয়াজ, শসা, গাজর কুচিয়ে সামান্য কাঁচা লঙ্কা আর আদার কুচি দিয়ে মাখালে মুড়ি খেতেও বেশ সুস্বাদু।

হাড়কে শক্ত করে:

মুড়ি ভিটামিন “ডি”, রাইবোফ্লাভিন এবং থিয়ামিনের উত্‍স। এতে রয়েছে ক্যালসিয়াম, আয়রন এবং ফাইবার। তাই মুড়ি খেলে হাড় দাঁত শক্ত হয়।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়:

পেটের সমস্যায় শুকনো মুড়ি কিংবা ভেজা মুড়ি খেলে তাৎক্ষণিক উপকার পাওয়া যায়। মুড়িতে ভিটামিন “বি” ও প্রচুর পরিমাণে মিনারেল থাকায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। পাশাপাশি হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।

রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে:

মুড়ি খুব সামান্য পরিমাণ সোডিয়াম কন্টেন্ট প্রসারিত করতে সহায়তা করে। মুড়িতে সোডিয়ামের পরিমাণ কম। তাই এটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। এটি রক্তচাপের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। মুড়ি খেলে উচ্চ রক্তচাপ এড়ানো যায়। এটি হার্ট অ্যাটাকের মতো হৃদরোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।

ওজন কমায়:

ওজন কমবে না বাড়বে এই সাধারণ অংকের হিসাবটা হলো আপনি কতটা ক্যালোরি গ্রহণ করছেন আর কতটুকু বার্ন করছেন। মুড়িতে ক্যালোরির পরিমান কম। মুড়িতে কোনো কলেস্টেরল নাই। তাই চর্বিবিহীন এই খাবারটি আমাদের খাদ্যতালিকায় রাখলে উপকারই হবে।

মুড়ি এসিডিটি নিয়ন্ত্রণ করে শরীরের ওজন কমাতে সাহায্য করে। পেট ভরে থাকে দীর্ঘক্ষণ। এই সুস্বাদু খাবার হতে পারে আমাদের স্বাস্থ্যকর ডায়েট স্ন্যাকস। অনেকটা পানি টেনে নেয় বলে মুড়ি খেলে বেশ খানিকটা সময় পেট ভরা থাকে, ফলে বার বার খাবার প্রবণতা কমে।

পেটের নানা গোলমালে শুকনো মুড়ি বা পানিতে ভেজা মুড়ি খাওয়ার রেওয়াজ অনেকের মধ্যে রয়েছে। হালকা খাবার হিসেবে মুড়ি কিন্তু বেশ কাজের।

মুড়ির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:

অন্যান্য cereal- যেগুলো আমরা খেয়ে থাকি তার তুলনায় মুড়ি কোনো অংশে কম নয়। তবে চানাচুর, তেল, মশলা, টেলি ভাজা চপ এগুলো সহযোগে মুড়ি না খাওয়াই ভালো। অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়। তাই যা খাবেন পরিমাণমতো খাবেন।

মুড়ির এত গুণ জানার পর হয়তো অনেকেই মুড়ি খাওয়ার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবেন। তবে একটু সাবধান। কারণ উপকারিতার পাশাপাশি এর কিছু  পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও রয়েছে। বেশি মুড়ি খেলে ডায়বেটিকের সম্ভাবনা থাকে। মুড়ির উচ্চ পরিমাণ গ্লাইসিমাইক রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তাই মুড়ি পরিমিত পরিমাণে খাওয়া ভালো।

আপনি যদি কোনো জটিল রোগে আক্রান্ত হন বা নিয়মিত কোনো মেডিকেল কোর্স-এর ভেতর দিয়ে যান তাহলে অবশ্যই আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাবেন।

সূত্রঃ

https://www.netmeds.com/health-library/post/puffed-rice-the-incredible-benefits-of-adding-murmura-to-your-diet