মায়েদের মেনোপজ অর্থাৎ মাসিক বন্ধ, অস্টিওপোরোসিস এর আগমন ও ক্যালসিয়ামের ঘাটতি।
মাসিক চক্রের যেমন শুরু রয়েছে তেমনি এর শেষও রয়েছে। নারীদের অল্প বয়সে এটি যেমন শুরু হয় তেমনি পরিণত বয়সের একটা সময়ে এর সমাপ্তি ঘটে। মেনোপজ হল সেই সময় যা আপনার মাসিক চক্রের সমাপ্তি চিহ্নিত করে।
মেনোপজ একটি প্রাকৃতিক জৈবিক প্রক্রিয়া। আপনার ৪০ বা ৫০ এর দশকে মেনোপজ বন্ধ হতে পারে। এই সময়ে ১২ মাস মাসিক বন্ধ থাকা আপনার মেনোপজ-এর আগাম সংকেত।
বেশীরভাগ নারীদের ৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সে পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। নারীদের শরীরে এই পরিবর্তন আসার পেছনে মূল কারণ ইস্ট্রোজেন নামের একটি হরমোন। মাসিক চক্র নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি, ইস্ট্রোজেন প্রজনন নালী, মূত্রনালী, হৃদপিণ্ড এবং রক্তনালী, হাড়, স্তন, ত্বক, চুল, শ্লেষ্মা ঝিল্লি এবং মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে।
মেনোপজের পর নারীদের বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেয়। হাড়ের ভঙ্গুরতা তার মধ্যে অন্যতম। বয়স বাড়লে স্বাস্থ্যগত সমস্যাও বেড়ে যায়। এটা খুবই সাধারণ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। তবে বয়স বাড়লে পুরুষদের তুলনায় নারীরা বেশি স্বাস্থ্য সমস্যার শিকার হন। আর এই সমস্যার ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকায় থাকে মেনোপজ।
মেনোপজকে সেই সময়ের বিন্দু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয় যখন বার্ধক্য থেকে ডিম্বাশয়ের oocytes- এর প্রাকৃতিক অবক্ষয়ের কারণে মাসিক চক্র স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
বয়স বাড়তে থাকলে নারীদের হাড়জনিত দুটি সমস্যায় আক্রান্ত হতে হয়। একটি হলো অস্টিওআর্থ্রাইটিস, অর্থাৎ হাঁটুর আর্থ্রাইটিস, অন্যটি হলো অস্টিওপোরোসিস, অর্থাৎ এমন একটি অবস্থা, যখন হাড় ক্রমেই ভঙ্গুর হতে থাকে।
প্রাথমিকভাবে এটি নীরব বেদনাশূন্য রোগ হলেও অস্টিওপোরোসিস হয় প্রধানত হাড়ে ক্যালসিয়াম ও খনিজ হ্রাস পেতে থাকলে। মেনোপজের পর দ্রুত হাড়ের অভ্যন্তরীণ গহ্বরে ক্ষয় হতে থাকে। আগে শুরু হলেও ৬০ বছর বয়সের পর একসময় তা জটিল আকার ধারণ করে।
মেনোপজের কারণে কি আপনাকে বৃদ্ধ দেখায়?
মেনোপজের কারণে আপনার ত্বকে অনেক পরিবর্তন আসে। আপনার শরীর কোলাজেন তৈরি করা বন্ধ করে দেয়। আপনি আপনার ত্বকের নিচে কিছু চর্বি হারান এবং আপনার ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা হ্রাস পায়।
হরমোনের পরিবর্তনের ফলে শুষ্কতার সাথে মিলিত হয়ে, স্যাগিং হতে পারে – বিশেষ করে ঘাড়, চোয়াল এবং গালের চারপাশে – এবং সূক্ষ্ম রেখা এবং বলি রেখা দেখা দিতে পারে।
অস্টিওপোরোসিস এর আগমন ও ক্যালসিয়ামের ঘাটতি:
মেনোপজের কারণে শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি দেখা দেয়। তাই এ সময় খাবারের ব্যাপারে বিশেষ নজর দিতে হবে। আর মাঝবয়সে সব ধরনের খাবারও খাওয়া যায় না। তাই নিয়ম করে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের দৈনিক ৮০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম প্রয়োজন হয়। আবার পোস্ট মেনোপোজাল নারীদের ক্ষেত্রে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ মিলিগ্রাম।
বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যতালিকায় সাধারণত যে খাবারগুলো থাকে, তা থেকে দৈনিক একজন মানুষ ৪২৭ থেকে ৫১২ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম পেতে পারেন। আর তাই ক্যালসিয়ামের দৈনিক যে চাহিদা, তা পূরণ করতে সাপ্লিমেন্টাল বা সম্পূরক ক্যালসিয়াম গ্রহণই সর্বোত্তম উপায়।
ক্যালসিয়ামপ্রাপ্তির যাত্রা শুরু হয় রক বা চুনাপাথর থেকে প্রাপ্ত ক্যালসিয়ামের মাধ্যমে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের শুরুর দিকে এটিই ছিল ক্যালসিয়ামের মূল উৎস। রক বা চুনাপাথর থেকে পাওয়া ক্যালসিয়ামের শোষণমাত্রা ৩১ শতাংশ, অর্থাৎ এই উৎস থেকে পাওয়া ৫০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট থেকে ক্যালসিয়াম পাওয়া যায় মাত্র ১৫৫ মিলিগ্রাম। এ ছাড়া এই ক্যালসিয়াম হজমে সমস্যা হওয়ার কারণে পাকস্থলীতে অস্বস্তি তৈরি হয় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য হয়।
পরবর্তী সময়ে আসে প্রবাল বা কোরাল থেকে পাওয়া ক্যালসিয়াম। রক বা চুনাপাথর থেকে পাওয়া ক্যালসিয়ামের তুলনায় এর শোষণমাত্রা বেশি হলেও (৬৯ শতাংশ), অর্থাৎ এই উৎস থেকে প্রাপ্ত ৫০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট থেকে ক্যালসিয়াম পাওয়া যায় ৩৪৫ মিলিগ্রাম।
এতে অতিরিক্ত পরিমাণ হেভি মেটাল, যেমন সিসা ও পারদের উপস্থিতি রয়েছে। ফলে দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে নিউরোনাল ড্যামেজের ঝুঁকি বেড়ে যায়, যা গর্ভাবস্থায় ব্যবহারে অদূর ভবিষ্যতে মা ও শিশুর বিভিন্ন ক্ষতি হতে পারে বলে বিভিন্ন জার্নালে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
এরপর আসে শৈবাল বা অ্যালজি (উদ্ভিদ) থেকে পাওয়া ক্যালসিয়াম। শৈবাল থেকে প্রাপ্ত ক্যালসিয়াম কি ভাল?
একটি দীর্ঘমেয়াদী সমীক্ষা অনুসারে, শেত্তলা বা শৈবাল থেকে প্রাপ্ত ক্যালসিয়াম বা তৈরিকৃত ক্যালসিয়াম পরিপূরক মহিলাদের বয়স-সম্পর্কিত হাড়ের ক্ষয় সহ হাড়ের খনিজ ঘনত্ব বাড়িয়ে তুলতে পারে।
সমুদ্র থেকে প্রাপ্ত সামুদ্রিক শৈবাল, বিশেষ করে সবুজ শৈবাল, ক্যালসিয়াম 35 এর মতো খনিজ সমৃদ্ধ। উদাহরণস্বরূপ, অ্যাকুইমিন, একটি সাধারণ ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ পরিপূরক যা লাল সমুদ্রের শৈবাল লিথোথামনিয়নের ক্যালসিফাইড কঙ্কালের অবশিষ্টাংশ থেকে প্রাপ্ত।
AlgaeCal দাবি করে যে, তাদের পণ্য উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত হওয়ায় এটি শরীরে ক্যালসিয়াম শোষিত হওয়ার মাত্রা বৃদ্ধি করে। যাইহোক, শৈবাল থেকে প্রাপ্ত ক্যালসিয়াম এখনও শুধু ক্যালসিয়াম কার্বোনেট।
এই উৎস থেকে পাওয়া ৫০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট থেকে ক্যালসিয়াম পাওয়া যায় ৩৭৫ মিলিগ্রাম। এ ছাড়া এই উৎস থেকে প্রাপ্ত ক্যালসিয়ামের আরও বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন অনিরাপদ মাত্রার সিসার উপস্থিতি, ক্যালসিয়াম হজমে দুর্বলতা ইত্যাদি।
আর তাই আরও ভালো ক্যালসিয়ামের উৎসের খোঁজ চলতে থাকে এবং অবশেষে পাওয়া যায় এগ শেল বা ডিমের খোসা থেকে প্রাপ্ত ক্যালসিয়াম।
এগ শেল বা ডিমের খোসা থেকে প্রাপ্ত ক্যালসিয়াম একমাত্র অর্গানিক ক্যালসিয়াম, যার কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য এটিকে অন্যান্য ক্যালসিয়াম প্রিপারেশনের চেয়ে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।
একটি ডিমের খোসা একজন প্রাপ্তবয়স্কের জন্য দৈনিক প্রস্তাবিত ক্যালসিয়ামের দ্বিগুণ পরিমান প্রদান করতে পারে, যা এটিকে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ সেরা খাবারের মধ্যে একটি করে তোলে।
ডিমের খোসা ভোজ্য, এবং এর বেশ কিছু আকর্ষণীয় প্রমাণ রয়েছে যে ডিমের খোসা খাওয়া আপনার স্বাস্থ্যের জন্য ভাল হতে পারে, বিশেষত যদি আপনি আপনার ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। এটি অর্গািনক উৎস থেকে পাওয়া এবং কোনো ধরনের ভারী ধাতুর উপস্থিতি থেকে মুক্ত, যা সর্বোচ্চ কার্যকারিতা ও সুবিধা নিশ্চিত করে।
এটি ৯০ শতাংশ শোষণ নিশ্চিত করে। ফলে এই উৎস থেকে প্রাপ্ত ৫০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট থেকে ক্যালসিয়াম পাওয়া যায় ৪৫০ মিলিগ্রাম। ভিটামিন ডি-৩-এর উপস্থিতির কারণে সর্বোচ্চ ক্যালসিয়াম হাড়ে সরবরাহ করে মজবুত হাড় গঠনে সাহায্য করে।
ক্যালসিয়ামের আরও নতুন নতুন উৎসের খোঁজ এখনো অব্যাহত আছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আরও নতুন কোনো উৎসের ক্যালসিয়াম যেটি আরো বেশি সুবিধা ও কম অসুবিধা অর্থাৎ হজমবান্ধব ও ক্ষতিকর পদার্থের অনুপস্থিতি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণে আরো ভালোভাবে সাহায্য করবে।