বর্তমান সমাজে “ভালোবাসার” কেন এতো অভাব?
হিংসা ও স্বার্থপরতার এই দুনিয়ায় আসলেই ভালোবাসার বড়োই অভাব। মানুষ আর মানুষের থাকছে না। মানুষ আর মানুষকে নিয়ে ভাবছে না। নিষ্ঠুর এই পৃথিবীতে আমরা যার যার স্বার্থ নিয়ে ব্যাস্ত। স্বার্থ উদ্ধার হলে দুঃখ দিয়ে কেটে পড়ি।
সবাই মিষ্টি কথা বলে মন ভোলাতে চাই। কিন্তু আমরা যদি একটু উদার মন নিয়ে, একটু ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে আসি তাহলে অনেক ভালো কাজ করা সম্ভব। সমাজটাকে উন্নত করা সম্ভব।
একত্রিত হয়ে অপকর্ম করি, ভাল কাজ করি না
৫ টা ছেলে ৫ মিনিটে এক জায়গায় একত্রিত হয়ে যাই কাউকে মারার জন্য বা কাউকে খুন করার জন্য। ৫ টা ছেলে ৫ মিনিটে এক জায়গায় একত্রিত হয়ে যাই মদ খাবার জন্য বা নেশা করার জন্য। মানিব্যাগ থেকে টাকা বেরোচ্ছে, মোদের বোতল আসছে, আনন্দে হৈ হুল্লোড় হচ্ছে।
কিশোর গ্যাং তৈরি করে কতনা অপকর্ম করছি। কিন্তু ৫ টা ছেলেকে ১ মাসেও এক জায়গায় করা যায়না- বাড়ির পাশে বা এলাকায় অসহায় বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ওষুধ নেই, খাবার নেই, ১০-২০ টাকা করে চাঁদা তুলে তাদের সাহায্য করার। কেন আমরা ভালোবাসতে পারি না?
সাহায্য না করে ছবি তুলি:
ঢাকার ব্যস্ততম রাস্তায় এক্সিডেন্ট হয়েছে। পরিবহনের বাস একজনকে ধাক্কা মেরে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। লোকটি চিৎকার করে বলছে- আমাকে বাচ্চাও। আমাকে কেউ হাসপাতালে পোঁছে দাও। অনেকেই ছবি তুলছে। ভিডিও হচ্ছে। ফেসবুকে লাইভ পোষ্ট হচ্ছে।
কিন্তু কেউ তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে তাকে হাসপাতালে বা ক্লিনিকে নিচ্ছে না। কেটে পড়ি বাবা। কি জানি আবার কোন পুলিশ কেসে ফেঁসে যাই। অনেক পরে লোকটিকে হাসপাতালে নিতে নিতে ভ্যানের পরে মারা যায়। কেন ভালোবাসার এতো অভাব?
মেয়েদের উত্যক্ত করলে প্রতিবাদ করি না
একটা মেয়ে স্কুল বা কলেজে যাচ্ছে। তার পিছনে ৫-৬ টা ছেলে লেগেছে। তাকে পিছন থেকে শিশ দিচ্ছে। তাকে বিভিন্নভাবে উত্যক্ত করছে। আমরা সাথে সাথে এগিয়ে না গিয়ে এড়িয়ে যাচ্ছি।প্রতিদিনই আমাদেরই কোনো মা-বোনের সম্ব্রমহানি করা হচ্ছে, ধর্ষণ করা হচ্ছে, কিন্তু কতটুকু ভালোবাসা নিয়ে আমরা তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি।
প্রতি ঘন্টায় ডিভোর্স:
সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা শহরে ডিভোর্স বা তালাকের যে আবেদন জমা পড়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে প্রতি ঘন্টায় একটি করে ঘর ভেঙ্গে যাচ্ছে। কেন মানুষ এতো সহজে সম্পর্ক ভেঙে দিচ্ছে? কেন সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না? কেন সম্পর্কগুলো জটিল হয়ে যাচ্ছে? কেন অনেক চেষ্টার পরেও আমরা সম্পর্ক জোড়া লাগাতে পারছি না? প্রতিবার ব্যর্থ হচ্ছি। এগুলো আসলেই ভাববার সময় এসেছে।
ভালোবাসা কি?
ভালোবাসা হলো অনুভূতি, আচরণ এবং বিশ্বাসের একটি দৃঢ মিশ্রণ। অন্য ব্যক্তির প্রতি স্নেহ, প্রতিরক্ষামূলকতা, উষ্ণতা এবং শ্রদ্ধার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। ভালবাসা মানবেতর প্রাণীদের ক্ষেত্রে, নীতিতে এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কোনও ব্যক্তি বলতে পারেন যে সে তার কুকুরকে ভালবাসে, স্বাধীনতা পছন্দ করে বা ঈশ্বরকে ভালবাসেন।
ভালোবাসা মানুষের অনুভূতি প্রকাশের সর্বোচ্ছ স্তরের নাম। এটি আমাদের দৈনন্দিন সম্পর্কে মিশে সেগুলোকে আরো শুদ্ধ করে তোলে। পরিবার থেকে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে এর পরিধি বাড়তে থাকে। কিন্তু বর্তমান আধুনিক সময়ে এসে ভালোবাসা সমৃদ্ধ সম্পর্ক চারপাশে দিন দিন কমে যাচ্ছে। রিলেশনশিপ দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না এখন আর। সম্পর্কের পৃথিবীটা দিন দিন কেমন যেনো ঘরের ভিতর বন্দি হয়ে যাচ্ছে। কারণ আধুনিকতার মোড়কে আমাদের চিন্তাভাবনার বিশাল পরিবর্তন ঘটেছে। মায়া, মমতা, কর্তব্যবোধ কোথায় যেনো হারিয়ে যাচ্ছে। এই পরিবর্তনের কারণে সম্পর্কের স্থায়িত্বও কমে গেছে।
কেন ভালোবাসার এতো অভাব?/বর্তমান সম্পর্কগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয় না কেন ?
ছাড় দিতে প্রস্তুত নই
বস্তুতঃ আমরা অনেক কিছুতে প্রস্তুত নই। আমরা কোনো ছাড় দিতে প্রস্তুত নই। কোনো আপস করতে প্রস্তুত নই। অন্যের আবেগ বা মতামতকে মূল্য না দিয়ে নিজের ভুল ধারণাকে প্রাধান্য দেয়া। শর্ত ছাড়া ভালোবাসার জন্য প্রস্তুত নই। একটা সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখতে হলে আমাদের যে যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে তা মানতে আমরা রাজী নই।
সহজে পেতে চাই আবার সহজে ছেড়ে দিতে চাই
আমরা সবকিছুকে সহজে পেতে চাই। আবার সবকিছুকে সহজে ছেড়ে দিতে চাই। এগুলোর ফলে কোনো ছোটো বাঁধা আমাদের সামনে এলে সবকিছু শেষ হয়ে যায়। যার কারণে ভালোবাসা পরিণত হওয়ার আগেই আমরা সম্পর্ক থেকে সরে আসি।
ভালোবাসা খুঁজি না
আমরা এখন ভালোবাসা খুঁজি না, শুধু একটা ঘোরের মধ্যে থেকে নিজেদের রোমাঞ্চিত করতে চাই। আমরা সপ্তাহান্তে সিনেমা দেখে কিংবা পার্টিতে উপস্থিত হবার জন্য একজনকে চাই। কিন্তু যে আমাদের গভীর নীরবতার কারণও বুঝবে এমন একজনকে চাই না। সুখে দুঃখে, বিপদে আপদে সমব্যাথী হবে। আমরা একসাথে সময় কাটাতে আগ্রহী কিন্তু স্মৃতি গর্তে আগ্রহী না।
সঙ্গী সারাজীবনের জন্য চাই না
আমরা একঘেয়েমীর মধ্যে থাকতে চাই না। সারাজীবনের জন্য একজন সঙ্গীকে নির্বাচন করি না। কেবল সাময়িক সময়ে নিজেকে প্রাণবন্ত রাখতে সঙ্গী নির্বাচন করি। যখন আমাদের এই ঘোর কেটে যাই তখন একে অন্যের উপর আগ্রহ হারাতে থাকি। আমরা রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে অন্ধবিশ্বাস রাখি বলে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সৌন্দর্যকে বিশ্বাস করতে চাই না।
পর্যাপ্ত সময় ও ধৈর্য থাকে না
আমরা ভালোবার জন্য অন্যের প্রতি যে স্নেহ, শ্রদ্ধা, প্রতিরক্ষামূলক আচরণ, অনুভূতি, বিশ্বাস,আবেগ এগুলোকে পাত্তা না দিয়ে নগর জীবনের নানা বিষয়ে নিত্য বিভোর থাকি। একটি সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের পর্যাপ্ত সময় ও ধৈর্য থাকে না। বস্তুগত সময়গুলোতে আমাদের ব্যাস্ত সময় কাটে। তাই ভালোবাসার মতো অবস্তুগত সম্পর্ককে লালন করতে পারি না। বর্তমানে সম্পর্ক কেবল একটি স্বছন্দবোধের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।