শালিক ও ময়নার গল্প।
একদা এক বনে বাস করত একটি শালিক ও একটি ময়না পাখি। তাদের দু’জনের মধ্যে ছিল খুব ভালো বন্ধুত্ব। একজনকে ছাড়া আরেকজন কোনো কিছু ভাবতেই পারত না। একদিন ময়না পাখি খাবারের খোঁজে একটি গ্রামে গিয়েছিল।
সে গ্রামের মানুষ ময়নাকে দেখে। একজন আরেকজনকে বলে দেখ দেখ কত সুন্দর পাখি। এটা আবার মানুষের মতো কথাও বলতে পারে। ময়না দূর থেকে নিজের প্রসংশা শুনে খুবই আপ্লুত।
নিজের প্রশংসা শুনতে কার না ভালো লাগে। ঠিক তেমনি ভাবে সেও নিজের প্রশংসা শুনে আনন্দিত। সে আরো কাছ থেকে নিজের প্রশংসা শোনার জন্য লোকগুলোর কাছাকাছি এলো।
এসে বলছে, ওহে, সৃষ্টির সেরা মানুষ। তোমরা আমাকে নিয়ে কী কথাবার্তা বলছ? তাদের মধ্যে একজন লোক বলল, তুমি খুব সুন্দর, সবার নজর কাড়ে তোমার কথা ও রূপ। তোমার কথাবার্তাও খুব মিষ্টি।
সে বলে তাই বুঝি ভাইয়েরা? লোকগুলো বলে তুমি এত সুন্দর ও আমাদের মতো কথাও বলতে পারো, তাহলে বনে কেন পড়ে আছ? চলে এসো না আমাদের গ্রামে। আমাদের সাথে থাকতে।
ময়না নিজের প্রশংসা শুনে আত্মগরিমায় ডুবে গেছে। তাই সে ভুলে গেছে পাখিদের যে বনেই সুন্দর মানায়। পাখিদের ধর্মই হচ্ছে স্বাধীনভাবে ডানা মেলে তেপান্তরে মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়ানো। সে কথা ভুলে গিয়ে বলে ঠিক আছে।
আমি আজই একেবারে চলে আসব তোমাদের গ্রামে। এখন আমি আসি, দুপুরবেলা আসব। তারা বলে ঠিক আছে। দুপুরবেলা এখানেই এসো, আমরাও আসব। ময়না বলে ঠিক আছে ভাইয়েরা। তাহলে এখন আমি আসি। এই বলে নীল আকাশে ডানা মেলে উড়ে যেতে যেতে ভাবছে।
আমি এত সুন্দর আর আমার কথাবার্তা এত মিষ্টি, আর আমি কিনা পড়ে আছি ওই শালিকের সাথে বনে।
বাসায় গিয়ে দেখে শালিক নেই। সে শালিকের জন্য অপেক্ষা করছে। কল্পনায় দেখছে গ্রামের মানুষে তাকে মাথায় করে রাখছে। আর ভালো ভালো খাবার খেতে দিচ্ছে। কষ্ট করে আর খাবার খুঁজতে হচ্ছে না। হঠাৎ শালিক এলো। কাছে এসে দেখল ময়না একা একা কথা বলছে আর লাফালাফি করছে।
সে জিজ্ঞেস করল কী ব্যাপার বন্ধু, আজকে এত খুশি খুশি লাগছে। কোনো সুখবর আছে নাকি? ময়না বলল, হ্যাঁ, অবশ্যই খুশির খবর। তবে তোমার জন্য খারাপ খবরও হতে পারে। শালিক উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল কী এমন খবর তোমার জন্য ভালো আর আমার জন্য খারাপ হতে পারে।
সে বলে আমি দেখতে এত সুন্দর আর আমার কথাবার্তা মানুষের মতো মিষ্টি। তাহলে আমি কেন বনে কিংবা তোমার সাথে থাকব। আমার কথার মতো যাদের কথা মিষ্টি আমি তাদের সাথেই থাকব।
শালিক অশ্রুভেজা নয়নে বলে, তাই তো তুমি দেখতে খুব সুন্দর, কথাবার্তাও মিষ্টি। এটা আমি না শুধু জগতের সবাই বলবে। ময়না বলে এই তো এতদিন পর তুমিও বুঝলে।
শালিক বলে তো কোথায় যাবে? সে বলে আমি মানুষের সাথে থাকব। শালিক বলে এত দিনের বন্ধুত্ব ভেঙে চলে যাবে কি? ময়না বলে দরকার হলে তাই করব। শালিক বলে আমাকেও নিয়ে যাও তোমার সাথে।
ময়না বলে আমি পাগল নাকি তোমার মতো কুৎসিত একটা শালিককে আমার সাথে নেব। শালিক বলে তাহলে শোন, আমি জানি তোমার বিপদ হবে মানুষের কাছে গেলেই।
মানুষ পাখিদের খাঁচায় বন্দী করে রাখে। এটাই চিরন্তন সত্যি কথা। তোমাকেও তারা বন্দী করে রাখবে। তাই আমিও চেয়েছিলাম সুখে দুঃখে তোমার সাথে থাকতে।
ময়না বলে তোমার মতো তারা এত হিংসুটে নয় যে অন্যের ভালো দেখতে পারে না। হিংসায় আজেবাজে বকে যাচ্ছ। শালিক বলে আমি তোমার ভালো চাই। কখনো খারাপ চাই না। ময়না বলে আমার ভালমন্দ নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। নিজের চিন্তা করো।
আমি এখনই চলে যাবো সেই গ্রামে মানুষের কাছে। শালিক বলে বন্ধু এমন ভুল করো না। তুমি যেও না, তাদের কাছে গেলেই বন্দী করে রেখে দেবে।
সে বলে সেটা আমি ভালো জানি কি করবে। এই বলে সে উড়ে যায়। শালিকও যায় তার পিছু পিছু।
উড়ে গিয়ে ময়না একটা বড় জারুল গাছে বসে। শালিক তার চেয়ে দূরে একটা গাছে বসে। এরই মধ্যে ময়নাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য মানুষগুলো আসে। শালিক তাদের দেখেই চিনেছে, তারা যে শিকারি। সেদিন তাকে ধরার জন্য ফাঁদ পেতেছিল।
শিকারিরা ময়না পাখিকে খাবারের লোভ দেখিয়ে কাছে নিয়ে গেল। যেই না ময়না খাবার খেতে লাগল। তখনই শিকারিরা ময়নাকে ধরে খাঁচায় বন্দী করে দিলো।
ময়না বলে আমাকে খাঁচায় কেন রাখছ ভাইয়েরা। আমাকে বের করো আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। শিকারি বলে এই খাঁচাই তো তোমার আসল ঠিকানা।
ময়না বলে এভাবে আমাকে ধোঁকা দিলে ভাইয়েরা। আমি নিজের প্রশংসা শুনে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনলাম।
শালিকের কথা শুনলে এভাবে বন্দী হয়ে থাকতে হতো না। শালিক দূর থেকে বলে, “নিজের প্রশংসা নিজে শুনে, বিভোর হলে শেষ পরিণতি এমনই হয়।”